বাবাজী মহারাজের দর্শনলাভ | যোগী-কথামৃত - পরমহংস যোগানন্দ

শান্তমধুর নিদাঘ নিশীথ। মাথার উপর বড় বড় উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো আকাশের বুকে আলো বিকিরণ করে চারিদিকে একটা স্বপ্নের মায়াজাল রচনা করেছে। শ্রীরামপুর আশ্রমের বারান্দায় শ্রীযুক্তেশ্বরজীর পাশে আমি বসে আছি। জিজ্ঞাসা করলাম, "গুরুদেব, আপনি কখনও বাবাজীর দর্শন পেয়েছেন?" শুনে তাঁর চোখদু'টি ভক্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমার এই সোজাসুজি প্রশ্নে একটু হেসে তিনি উত্তর দিলেন, "হ্যাঁ, পেয়েছি বই কি! আমার বহু পূণ্যবলে বলে আমি তিন তিনবার এই অমর মহাগুরুর সাক্ষাৎ পেয়েছি। প্রথমবার আমাদের সাক্ষাৎ হয় এলাহাবাদের 'কুম্ভমেলায়'।" ভারতবর্ষে কুম্ভমেলার মত ধর্মীয় মহামেলা স্মরণাতীত যুগ হতে চলে আসছে। এইসব ধর্মীয় মহামেলা অগণিত লোকের চোখের সামনে একটা আধ্যাত্মিক লক্ষ্য সর্বদা ধরে রেখে আসছে। হাজার হাজার সাধুসন্ন্যাসী যোগীঋষিদের দর্শনলাভের জন্য লক্ষ লক্ষ ভক্ত প্রতি বার বৎসর অন্তর একবার করে মেলায় সমবেত হন। এমনসব সাধুসন্ন্যাসীরাও আছেন, যারা কেবলমাত্র একবার মেলায় এসে সংসারী নরনারীদের পূণ্য আশীর্বাদবর্ষণ করা ছাড়া আর কখনও তাঁদের নির্জন স্থান হতে প্রকাশ্যে আসেন না। 


শ্রীযুক্তেশ্বর গিরিজী বলতে লাগলেন, "বাবাজীর সঙ্গে যখন আমার সাক্ষাৎ হয় তখনও আমি সন্ন্যাস গ্রহণ করিনি। তবে লাহিড়ী মহাশয়ের কাছ থেকে তখন আমার "ক্রিয়াযোগে" দীক্ষা নেওয়া হয়ে গেছে। ১৮৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে এলাহাবাদে যে কুম্ভমেলা হয়, তাঁরই উৎসাহে আমি সে মেলাতে যোগদান করি। সেই আমার প্রথম কুম্ভমেলা দর্শন। দারুণ ভিড় আর হট্টগোলের মাঝে আমি একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। 
চতুর্দিকে আমার আগ্রহব্যাকুল দৃষ্টির সম্মুখে কোন প্রকৃত সদ্‌গুরুর পূণ্যমূর্তির আবির্ভাব ঘটল না। গঙ্গার তীরে একটা পোলের কাছ দিয়ে যাচ্ছি, চোখে পড়ল একটি পরিচিত মূর্তি ----- কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন ভিক্ষাপাত্রটি বাড়িয়ে দিয়ে। 
"হতাশ হয়ে ভাবলাম, 'এ মেলাটা একটা ভিখিরীর দলের চেঁচামেচি আর হট্টগোল ছাড়া অন্য কিছুই নয়। আমার মনে হয় যে পশ্চিমের বৈজ্ঞানিকেরা, যারা মানবজাতির প্রত্যক্ষ মঙ্গলসাধনের জন্যে জ্ঞানের পরিধি ধৈর্যের সঙ্গে বাড়িয়ে চলেছেন, তারা কি এইসব, যারা ধর্মের ভণ্ডামি করে অথচ ভিক্ষাই যাদের একমাত্র উপজীবিকা, তাদের চেয়ে ভগবানের কাছে বেশি প্রিয় নন?' 
"সমাজসংস্কারের এই সব ছোটখাটো চিন্তাগুলি হঠাৎ পেল; দেখি, সামনে এক দীর্ঘকায় সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আমায় বলছেন, ----- 
"মশায়, এক সাধুজী আপনাকে ডাকছেন।'
"'কে তিনি?'
"'আসুন, এলে নিজেই দেখতে পাবেন।' 
"ইতস্ততঃ করে এই সংক্ষিপ্ত উপদেশটি পালন করতে গিয়ে এলাম একটি গাছতলায় ----- তার শাখাপ্রশাখার নিচে একজন গুরু তাঁর বেশ দর্শনযোগ্য দলবল নিয়ে বসে আছেন‌‌। গুরুজীর জ্যোতির্ময় মূর্তি অপূর্বদর্শন, ঘনকৃষ্ণ চক্ষুদু'টি অত্যুজ্জ্বল। আমার আগমনে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি আমায় আলিঙ্গন করে সস্নেহে বললেন, 'স্বাগত, স্বামীজী'!" 
"আমি জোরালো প্রতিবাদ করে বললাম, 'না মশায়, আমায় স্বামীটামী কিছু বলবেন না; আমি ওসব কিছু নই।' 
"দৈবাদেশে যাদের আমি "স্বামী" উপাধি দিই, তারা আর তা পরিত্যাগ করতে পারে না।' সাধুটি নিতান্ত সাধারণভাবে কথাগুলি বললেও কথাগুলির মধ্যে সত্যের গভীর দৃঢ়তা ছিল; সঙ্গে সঙ্গে মনে হল যেন দেবতার আশিসধারায় প্লাবিত হয়ে গেছি। আমার এরূপ হঠাৎ স্বামী পদবীতে পদোন্নতি লাভ হওয়াতে একটু হেসে, যিনি আমায় এরূপভাবে সম্মানিত করলেন, সেই নরদেহে দেবতারূপী মহাগুরুর চরণে আমি প্রণাম নিবেদন করলাম। 
"বাবাজী ------ কারণ তিনি ছাড়া আর কেউ নন ----- সেই গাছতলায় তাঁর নিকটে একটি আসনে আমায় বসতে বললেন। শরীর তাঁর বেশ দৃঢ় আর বলিষ্ঠ ----- দেখতে ঠিক লাহিড়ী মহাশয়ের মত। যদিও আমি এই দুই মহাগুরুর অদ্ভুত সাদৃশ্যের কথা বহুবার শুনেছিলাম, তবুও কিন্তু তখন তা আমার চোখে ঠিক ধরা পড়েনি। বাবাজীর এমন একটা শক্তি ছিল যে, কারোর মনে কোন বিশেষ চিন্তার উদয় হলে তা তিনি নিবারণ করতে পারতেন। বোধহয় সেই মহানগুরুর এই ইচ্ছা ছিল যে, তাঁর সামনে আমি সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবেই অবস্থান করি ----- তাঁর প্রকৃত পরিচয় পেয়ে বেশি অভিভূত হয়ে না পড়ি। 
"কুম্ভমেলা দেখে কি মনে হয়?' 
"'বড়ই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম, মশায়। পরে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, 'অবশ্য আপনার দর্শন না পাওয়া পর্যন্ত। কেন জানি না ----- আমার মনে হয় শান্তশিষ্ট সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গে এই সব হট্টগোল একেবারেই খাপ খায় না‌।' 
"গুরু মহারাজ বললেন, 'বৎস, ( যদিও দেখলে তাঁর দু'গুণ আমার বয়স বলে বোধ হবে ) 
বহুর দোষের জন্যে সবাইকেই একসঙ্গে বিচার করে বোসো না। পৃথিবীতে সব জিনিসই ভালমন্দে মিশানো ----- বালির সঙ্গে চিনির মিশ্রণ যেমন। চতুর পিপীলিকার মত হও; বালি ফেলে রেখে চিনির দানা খুঁটে নাও। যদিও অনেক সাধুসন্ন্যাসী এখানে এখনও মায়া আর ভ্রান্তিবশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তবুও মেলাতে এমন কিছু লোকও আছেন যাদের প্রকৃতই ঈশ্বরলাভ হয়েছে।' 
"মেলায় এই মহানগুরুর সাথে আমার নিজ দর্শনলাভের কথা স্মরণ করে আমি তৎক্ষণাৎ তাঁর কথায় সায় দিলাম। 
"আমি বললাম, 'মশায়, আমি পশ্চিমের বৈজ্ঞানিকদের কথাই ভাবছিলাম। বুদ্ধিতে তারা আমাদের এখানকার সমবেত বেশিরভাগ মানুষের চেয়েও কত বড়। কোন্ সুদূরদেশে ইউরোপ বা আমেরিকায় তারা বাস করেন ----- তাদের ধর্মমতও সব বিভিন্ন, আর এই বর্তমান মেলার মত সব মেলার প্রকৃত মূল্য কি, সে বিষয়েও তারা অজ্ঞ। তারা ভারতবর্ষের ধর্মগুরুদের সাক্ষাৎ পেলে খুবই উপকৃত হতে পারেন। বুদ্ধিবৃত্তিতে তারা খুব উন্নত হলেও বহু প্রতীচীবাসী একেবারে দারুণ জড়বাদী। অন্যেরা বিজ্ঞান বা দর্শনশাস্ত্রে সুপণ্ডিত হলেও সকল ধর্ম যে মূলতঃ এক, সে কথাটা তারা মানেন না। তাদের বিশ্বাসটাই হচ্ছে এক দুর্লঙ্ঘ্য বাধা, যা আমাদের কাছ থেকে তাদেরকে চিরতরেই পৃথক করে রেখেছে।'
"কথাটা মনোমত হওয়ায় বাবাজীর মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, 'দেখছি যে তোমার প্রাচ্য আর প্রতীচ্য এই দুই দেশের জন্যেই বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। সর্বমানবের জন্যেই তোমার উদারহৃদয় যে কেঁদে উঠেছে তা আমি আগে টের পেয়েছি, আর সেইজন্যেই তোমাকে এই জায়গায় ডেকে এনেছি। 
"তিনি বলতে লাগলেন, 'পূর্ব আর পশ্চিম এই দুই প্রান্তের মধ্যে কর্ম আর ধর্মসাধনার সুবর্ণময় মধ্যপথ রচনা করা উচিত। পশ্চিমের কাছ থেকে পার্থিব উন্নতির জন্যে ভারতবর্ষের যেমন অনেক কিছু শেখবার আছে, তেমনি তার প্রতিদানে ভারতবর্ষও পশ্চিমকে এমন এক সর্বজনীন প্রণালী শিক্ষা দিতে পারে যাতে করে সে যোগবিজ্ঞানের সুদৃঢ়ভিত্তির উপর তার ধর্মমত প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হবে। 
"স্বামীজী, পূর্ব-পশ্চিমের সুসঙ্গত ভবিষ্যৎ আদানপ্রদানের কাজে তোমায় অংশ গ্রহণ করতে হবে। বছরকয়েক বাদে আমি তোমার কাছে একটি শিষ্যকে পাঠাব যাকে পশ্চিমে যোগ প্রচারের কাজে তোমাকে তৈরী করে নিতে হবে। সেখানে বহু ধর্মপিপাসু আত্মার আকুল আহ্বান বন্যার মত আমার কাছে এসে পৌঁচচ্ছে। আমি অনুভব করছি যে, আমেরিকা আর ইউরোপে বহু সম্ভাব্য সাধুসন্তরা জাগরিত হবার জন্যে অপেক্ষা করছেন।" 
গল্পের এই স্থানে শ্রীযুক্তেশ্বর গিরিজী তাঁর পূর্ণদৃষ্টি আমার মুখের উপর স্থাপিত করলেন। 
শুভ্র চন্দ্রালোকে চারিদিক তখন হাসছে। শ্রীযুক্তেশ্বর গিরিজী একটু হেসে শুরু করলেন, "বৎস, তুমি হচ্ছ সেই শিষ্য, যাকে বাবাজী মহারাজ বহু বছর আগে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।" 
শুনে অবশ্য খুবই খুশি হলাম যে বাবাজীই আমাকে শ্রীযুক্তেশ্বর গিরিজীর কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু এও আমি তখন কিছুতেই ভাবে উঠতে পারছিলাম না যে আমার ভক্তিভাজন গুরুদেব আর তাঁর এই শান্ত আশ্রমভূমি ত্যাগ করে আমি পশ্চিমে গিয়ে থাকব কি করে, আর কি নিয়ে। 
শ্রীযুক্তেশ্বর গিরিজী তারপর বলতে শুরু করলেন, "বাবাজী তখন ভগবদ্ গীতা সম্বন্ধে বলতে লাগলেন। আমায় তাঁর কতকগুলো প্রশংসার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলাম যে গীতার বিভিন্ন অধ্যায়ের আমি যে কিছু ব্যাখ্যা লিখেছি, সে খবরও তিনি জানেন। 
"তারপর সেই মহানগুরু বললেন, স্বামীজী, আমার অনুরোধে আর একটি কাজের ভার তোমায় নিতে হবে। তুমি খ্রিস্টীয় আর হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের মূলগত ঐক্য প্রদর্শন করে একটি ছোট্ট বই লেখ না কেন? এই দুই শাস্ত্র থেকে সমভাবের উক্তিসকল পাশাপাশি উদ্বৃত করে দেখিয়ে দাও যে, ঈশ্বরের প্রিয়ভক্তেরা সবাই একই সত্য বলে গেছেন ------- এখন যা মানুষের সাম্প্রদায়িকতার অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন।' 
কতকটা সংশয়ের সঙ্গে বললাম, "মহারাজ, এ আপনার কি অদ্ভুত আদেশ! এ কি আমি পালন করতে পারব?" 
"বাবাজী মৃদু হেসে আশ্বাস দিয়ে বললেন, 'বাবা, সন্দেহ করছ কেন? আরে এ কার কাজ, আর সবকাজ কেই বা করায় বল? ভগবান আমায় দিয়ে যা কিছুই বলাচ্ছেন, তা সব সত্য হয়ে ফলে যেতে বাধ্য।'
"সাধুমহারাজের আশীর্বাদে মনে নববলের সঞ্চার হল, বই লিখতে সম্মত হলাম। বিদায় নেবার সময় উপস্থিত দেখে নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও পর্ণাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালাম। 
"গুরুমহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, 'লাহিড়ীকে জান?একজন মহাপুরুষ, নয় কি, কি বল? আমাদের যে দেখা হয়েছে তা তাকে বোলো!' বলে লাহিড়ী মহাশয়কে জানাবার জন্য আমায় একটা সংবাদ দিলেন। 
"বিদায়গ্রহণকালে ভক্তিভরে প্রণাম করে উঠতেই তিনি মধুর হেসে বললেন, 'তোমার লেখা শেষ হলেই আমি তোমায় দর্শন দেব ----- উপস্থিত এখন বিদায়!' 
"তার পরদিনই এলাহাবাদ পরিত্যাগ করে কাশীর ট্রেন ধরলাম। গুরুদেবের বাড়ী পৌঁছেই আমি কুম্ভমেলার সেই অপূর্ব সাধুটির সমস্ত বিবরণ তাঁর কাছে সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। 
"শুনে লাহিড়ী মহাশয়ের চোখ দু'টি আনন্দে নেচে উঠল, বলে উঠলেন, 'আরে তাঁকে চিনতে পারলে না --- ওঃ, দেখছি যে তা তো তুমি পারবে না কারণ তিনি ইচ্ছা করেই ধরা দেন নি। তিনিই হচ্ছেন আমার অদ্বিতীয় গুরুদেব ----- পরম ভাগবত বাবাজী মহারাজ!' 
"স্তম্ভিত হয়ে বললাম ---- 'বাবাজী! বলেন কি গুরুদেব, যোগিশ্রেষ্ঠ বাবাজী, আমাদের পতিতপাবন বাবাজী মহারাজ! ------ যিনি কখনও দৃশ্য কখনও অদৃশ্য! হায় হায়, একবার যদি সে দিন আজ ফিরে আসে আর তাঁর দর্শন পাই, তাহলে তাঁর চরণকমলে ভক্তিনিবেদন করে যে একেবারে ধন্য হয়ে যাই!'
"লাহিড়ী মহাশয় সান্তনা দিয়ে বললেন, 'যাক, কিচ্ছু ভেবো না ----- তিনি তো তোমায় দেখা দেবেন প্রতিজ্ঞা করেছেন, তবে আর ভাবনা কি?' 
"তারপর বললাম, 'গুরুদেব, বাবাজী মহারাজ আপনাকে একটি খবর দিতে বলেছেন‌। তিনি বললেন, "লাহিড়ীকে বোলো যে এ জীবনের সঞ্চিত শক্তি সব ফুরিয়ে আসছে ---- প্রায় শেষ হয়ে এল বলে!" 
"এই রহস্যময় কথাগুলো উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই লাহিড়ী মহাশয়ের দেহ থর থর করে কাঁপতে লাগল ---- যেন বিদ্যুৎপ্রবাহ স্পর্শ করেছে। মুহূর্ত  মধ্যে তাঁর চারিদিকে সবকিছু একেবারে নীরব হয়ে গেল, তাঁর সদাহাস্যময় আনন অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন হয়ে উঠল। আসনের উপর কাঠের মূর্তির মত গম্ভীর আর নিশ্চল তাঁর দেহ একেবারে বর্ণহীন হয়ে পড়ল। দেখেশুনে ভয় পেয়ে গিয়ে আমার বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেল। এমন সদানন্দময় পুরুষের এমন ভীতিপ্রদ গাম্ভীর্য আমি জীবনে আর কখনও দেখি নি। উপস্থিত অন্যান্য শিষ্যেরাও ভয়ে ভয়ে তাকাতে লাগল।
"গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে তিন ঘণ্টা কেটে গেল। তারপর লাহিড়ী মহাশয় পুনরায় তাঁর স্বাভাবিক প্রফুল্লভাব ধারণ করলেন, প্রত্যেক চেলার সঙ্গেই সস্নেহে কথাবার্তা কইতে লাগলেন। সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল। 
"গুরুদেবের এই প্রতিক্রিয়াতে আমি বুঝতে পারলাম যে, বাবাজী মহারাজের সংবাদে এমন একটা নিশ্চিত ইঙ্গিত ছিল যাতে করে লাহিড়ী মহাশয় টের পেয়েছিলেন যে তাঁকে শীঘ্রই দেহরক্ষা করতে হবে। তাঁর ভয়ঙ্কর গাম্ভীর্যে প্রমাণিত হল যে আমাদের গুরুদেব তৎক্ষণাৎ সঙ্গে সঙ্গে আত্মসংযম করে এখানকার পার্থিব আকর্ষণের শেষ বন্ধনটুকু ছিন্ন করে সেই পরমপুরুষের অনন্তসত্তার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। তিনি যেমন বলে থাকেন, বাবাজীর উক্তিতে সেটাই ছিল, 'আমি তোমার সঙ্গে সর্বদাই থাকব।' 
"যদিও বাবাজী আর লাহিড়ী মহাশয় উভয়েই সর্বজ্ঞ, আর আমার বা অন্য কোনও মধ্যস্থের দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে সংযোগরক্ষা করবার তাঁদের কোন আবশ্যকতাও ছিল না, তবুও এই সব বড় বড় মহাগুরুগণ প্রায়ই এই সংসারের নাট্যাভিনয়ে সাধারণ মানবচরিত্রের অংশই গ্রহণ করে থাকেন। মাঝে মাঝে তাঁরা কোন লোক মারফৎ অত্যন্ত সাধারনভাবে তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী প্রেরণ করেন, যাতে করে ভবিষ্যতে তাঁদের কথাগুলি ফলে গেলে পর, ঘটনাগুলো যারা শুনবে তাদের দৈবে আরও প্রগাঢ় বিশ্বাস জন্মায়। 
শ্রীযুক্তেশ্বর গিরিজী বলে যেতে লাগলেন, "কাশী ছেড়ে শীগগিরই শ্রীরামপুরে ফিরলাম, বাবাজীর অনুরোধে শাস্ত্রসম্বন্ধে লেখা শুরু করবার জন্যে। লেখা শুরু করবার সঙ্গে সঙ্গেই সেই অমরগুরুর নামে এক কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত হলাম। কলমের মুখ দিয়ে বিনাপ্রয়াসেই শ্রুতিমধুর পদগুলি বেরিয়ে এসে একটি সুন্দর কবিতা রচিত হয়ে গেল ---- আশ্চর্যের বিষয় এই যে এর পূর্বে আমি সংস্কৃত ভাষায় কবিতা রচনা করবার জন্যে কখন চেষ্টা পর্যন্তও করি নি। 
"নীরব নিশীথে, বাইবেল আর সনাতন ধর্মশাস্ত্রের তুলনামূলক বিচার আরম্ভ করলাম। প্রভু যীশুখ্রিষ্টের বাণী উদ্ধৃত করে দেখালাম যে, বেদের অন্তর্নিহিত সত্যের সঙ্গে তাঁর শিক্ষা মূলতঃ এক। আমার পরমগুরুর কৃপাতেই আমার বই "দি হোলি সায়েন্স" --এর রচনা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। 
গুরুদেব বলতে থাকেন, "লেখা শেষ হবার পরদিন সকালে এখানকার রায়ঘাটে গেলাম গঙ্গাস্নান করতে। ঘাটে তখন কেউ ছিল না; খানিকক্ষণ চুপচাপ রোদে দাঁড়িয়ে একটু আরাম উপভোগ করলাম। তারপর জলে গোটাকতক ডুব দিয়ে বাড়ীমুখো হলাম। পথঘাট জনহীন, কোন সাড়াশব্দ নেই। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে একমাত্র শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে প্রতি পদক্ষেপে আমার গঙ্গানাওয়া ভিজেকাপড়ের শপশপ শব্দ। গঙ্গার তীরে একটা খুব বড় বটগাছ ছিল; সে জায়গাটা পেরিয়ে আসতেই মনে কেমন যেন একটা প্রবল ইচ্ছার উদয় হল --- পিছন ফিরে একবার তাকাই। ফিরে দেখি ---- সেই প্রকাণ্ড বটগাছের ছায়ায় বসে বাবাজী মহারাজ, আর তাঁকে ঘিরে বসে তাঁর গুটিকতক শিষ্য! 
"'স্বাগত, স্বামীজী!' মহাগুরুর মধুর কন্ঠস্বর কর্ণে
প্রবেশ করতে নিশ্চিত হলাম যে সত্যিসত্যি আমি কোন স্বপ্ন দেখছি না। বাবাজী মহারাজ বলতে লাগলেন, 'দেখছি যে ভালভাবেই বইখানি লেখা শেষ হয়েছে ----- যাক, কথা দিয়েছিলাম যে আসব, তাই আজ এসেছি তোমায় ধন্যবাদ দিতে।' 
"দ্রুতস্পন্দিতহৃদয়ে, তাঁর চরণতলে পড়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে করজোড়ে নিবেদন করলাম, 'পরমগুরুজী, এই কাছেই আমার বাড়ী; আপনি আর আপনার চেলারা দয়া করে সেখানে একটু পায়ের ধূলো দিয়ে কি আমায় কৃতার্থ করবেন না?' 
"মহানগুরু মৃদুহাস্যে তা  প্রত্যাখ্যান করলেন, 'না বাছা! আমাদের এই গাছতলাটুকুই ভাল; কেন, এ জায়গা তো বেশ আরামের --- কোনই কষ্ট নেই।' কি আর করি, অগত্যা আর কোন উপায় না দেখে কাতরনয়নে তাঁকে নিবেদন করলাম, 'পরমগুরু মহারাজ, দয়া করে এখানে একটু অপেক্ষা করুন, কিছু ভাল মিষ্টি নিয়ে আমি এখুনিই ফিরে আসছি!' মিনিটকতক বাদেই  আমি কিছু মিষ্টি নিয়ে ফিরে এলাম। এসে দেখি, কি আশ্চর্য! সেই বিরাট গাছতলায় বাবাজী বা তাঁর দলবলের চিহ্নমাত্রও নাই! ঘাটের চারিদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম ---- নাঃ, কোথাও আর তাঁদের দেখতে পেলাম না, মনে মনে বুঝলাম যে তাঁরা শূন্যে অদৃশ্য হয়েছেন! 
"অন্তরে গভীর আঘাত পেলাম। মনে মনে বললাম, 'যাক, আবার আমাদের দেখা হলে তাঁর সঙ্গে কথাই বলব না! নিতান্তই নিষ্ঠুর তিনি, এমনভাবে হঠাৎ চলে যাওয়ার মানে কি?' অবিশ্যি এটা অভিমানের রাগ, তার বেশি আর কিছু নয়।
"মাসকতক বাদে কাশীতে লাহিড়ী মহাশয়কে দর্শন করতে গেলাম। ছোট্ট বৈঠকখানাটিতে ঢুকতেই গুরুদেব একটু হেসে আমায় বললেন, --- 
"'এস, এস, যুক্তেশ্বর! আচ্ছা আসবার সময় কি তুমি ঘরের দোরগোড়ায় বাবাজী মহারাজকে দেখতে পেলে?' 
"আশ্চর্য হয়ে বললাম, 'কই, না তো!' 
"'আচ্ছা, তাহলে কাছে এস, বলে লাহিড়ী মহাশয় আমার কপালের মাঝখানে হাত দিয়ে মৃদুস্পর্শ করলেন; সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাবাজীর জীবন্তমূর্তি ----- একটি পরিপূর্ণ শতদলের মতই প্রস্ফুটিত। 
"আমার সেই পুরানো আঘাতের কথা মনে পড়ল। প্রণাম করলাম না। লাহিড়ী মহাশয় অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। 
"বাবাজী মহারাজ তাঁর অতল স্নেহকোমল চোখদু'টি আমার ওপর স্থাপন করে বললেন, 'তুমি আমার উপর বড়ই বিরক্ত হয়েছ, তাই না?' 
"আমি বললাম, 'কেনই বা হব না বলুন! আপনার ভোজবাজির দলবল নিয়ে আপনি শূন্য থেকে উড়ে এলেন আবার সেই শূন্যেতেই মিলিয়ে গেলেন!'
"বাবাজী অতি স্নিগ্ধমধুর হেসে বললেন, 'আমি শুধু বলেছিলাম যে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব ---- কিন্তু কতক্ষণ ধরে থাকব, তা' তো আমি কিছুই বলিনি। তুমি তখন খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলে। তবে আমি একথা বলব যে তোমার চঞ্চলতার দাপটে আমি প্রায় শূন্যেই মিলিয়ে গিয়েছিলাম আর কি!' 
"এই সরল উত্তরে আমার মনের সকল ক্ষোভ তৎক্ষণাৎ দূর হয়ে গেল। তাঁর চরণতলে নতজানু হয়ে বসলাম; বাবাজী মহারাজ সস্নেহে আমার কাঁধ চাপড়ে দিলেন।
"তারপর বাবাজী আমায় বললেন, 'বাবা, আরও ধ্যান কর, আরও ধ্যান কর ------ তোমার দৃষ্টি এখনও বেশ নির্দোষ হয় নি; সূর্যের আলোর পিছনে যে আমি লুকিয়ে আছি, তা' তো তুমি আমায় দেখে বার করতে পারলে না।' স্বর্গীয় মধুর বংশীধ্বনির মত এই কথাগুলো বলেই বাবাজী মহারাজ অনন্ত জ্যোতিঃর মধ্যে বিলীন হয়ে গেলেন।

           যোগী-কথামৃত
( Autobiography of a Yogi )
   শ্রী শ্রী পরমহংস যোগানন্দ 
                 বিরচিত

পূজনীয় ও পরমারাধ্য আমার গুরুদেব
শ্রী শ্রী স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের
শ্রীকরকমলে অর্পিত।

মৎপ্রণীত ইংরাজী " অটোবায়োগ্রাফি অফ্ এ যোগী'র বঙ্গানুবাদে শ্রীমান ইন্দ্রনাথ শেঠের স্বেচ্ছা প্রণোদিত প্রয়াস ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ ও আশির্বাদ জানাই।
                                   - পরমহংস যোগানন্দ



আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নুতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নুতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।

ভারতের সাধক ও সাধিকা
     পুণঃপ্রচারে বিনীত 
           প্রণয় সেন
               প্রণয়
Share on Google Plus

About Indian Monk - Pronay Sen

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.

0 comments :

Post a Comment