স্বামী বিবেকানন্দ বিরচিত 'ভক্তিযোগ'

ॐ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়।। স্বামী বিবেকানন্দ বিরচিত 'ভক্তিযোগ' গ্রন্থের নির্বাচিত অংশ।।

⬛ ⬛ ভক্তির লক্ষণ~~~ 
ভগবানে পরম প্রেমই ভক্তি। অকপটভাবে ঈশ্বরের অনুসন্ধানই ভক্তিযোগ; প্রীতি এর আদি, মধ্য ও অন্ত। (এই) ভক্তি স্বয়ংই সাধ্য ও সাধনস্বরূপা। বিষয়বাসনা থাকতে এই প্রেমের উদয়ই হয় না। ভক্তরাজ প্রহ্লাদ ভক্তির যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তাই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। ‘অজ্ঞলোকের ইন্দ্রিয় বিষয়ে যেমন তীব্র আগ্রহ হয়, তোমাকে স্মরণ করার সময় তোমার প্রতি তেমন তীব্র আসক্তি যেন আমার হৃদয় থেকে অপসারিত না হয়।’



⬛ ⬛ ঈশ্বরের স্বরূপ~~~ 
‘তিনি অনির্বচনীয় প্রেমস্বরূপ।’ ভাগবত পুরাণে আছেঃ "শ্রীহরির এমনই গুণ যে, যেসব মুনি আত্মারাম, যাঁদের সকল বন্ধন চলে গেছে তাঁরাও ভগবানের প্রতি অহৈতুকী ভক্তি না করে পারেন না।" যাকে শ্রুতি ‘নেতি, নেতি’ বলে বর্ণনা করেছেন, যেখানে জ্ঞান জ্ঞেয় বা জ্ঞাতা নেই, ‘সেখানে কে কাকে দেখে?’ কিন্তু যাঁরা সেই অবস্থায় যেতে ইচ্ছা করেন না, তাঁরা সেই এক অবিভক্ত ব্রহ্মকে প্রকৃতি, আত্মা, এবং ঐ উভয়ের অন্তর্যামী ঈশ্বর—এই তিনরূপে বিভক্ত দেখেন। ভক্তির ঊর্ধ্বতর স্তরে যখন প্রহ্লাদ নিজেকে ভুলে গেলেন, তখন তিনি জগৎ ও তাঁর কারণ—কিছুই দেখতে পেলেন না, সমস্তই  তাঁর কাছে নামরূপ দ্বারা বিভক্ত নয়—এমন এক অনন্তরূপে মনে হয়েছিল। কিন্তু যখনই তাঁর বোধ হল—তিনি প্রহ্লাদ, অমনি তাঁর কাছে জগৎ ও অশেষ কল্যাণ গুণরাশির আধারস্বরূপ জগদীশ্বর প্রকাশ হলেন। মহাভাগা গোপীদেরও এই অবস্থা হয়েছিল। যতক্ষণ তাঁরা কৃষ্ণের প্রতি গভীর অনুরাগে ও প্রেমে অহংজ্ঞানশূন্য ছিলেন, ততক্ষণ তাঁরা সকলেই কৃষ্ণরূপে পরিণত হয়ে গেছিলেন। যখন তাঁরা কৃষ্ণকে আবার উপাস্যরূপ পৃথ‌ক্‌ভাবে চিন্তা করতে লাগলেন, তখন তাঁরা আবার গোপীভাব প্রাপ্ত হলেন। তখনই ‘তাঁদের সামনে পীতাম্বরধারী, মাল্যভূষিত ও সাক্ষাৎ মন্মথের মন মথনকারী কৃষ্ণ আবির্ভূত হলেন।’ 

⬛⬛ প্রত্যক্ষানুভূতিই ধর্ম~~~ 
ভক্ত শীঘ্রই ঈশ্বরকৃপায় এমন এক অবস্থায় উপনীত হন, যেখানে পণ্ডিতদের শুকনো যুক্তি অনেক নীচে পড়ে থাকে, আর বুদ্ধির সাহায্যে অন্ধকারে বৃথান্বেষণের পরিবর্তে প্রত্যক্ষানুভূতির উজ্জ্বল সূর্যালোক প্রকাশিত হয়। তখন তিনি আর বিচার বা বিশ্বাস কিছুই করেন না, তিনি প্রত্যক্ষ অনুভব করেন। তিনি আর তর্ক করেন না, উপলব্ধি করেন। এই প্রত্যক্ষানুভূতি রাশি রাশি বাক্‌প্রপঞ্চ ও মূর্খ-সুলভ ভাবোচ্ছ্বাসের থেকে সহস্রগুণে শ্রেষ্ঠ। 

⬛⬛ ভক্তির প্রস্তুতি—ত্যাগ~~~ 
যখনই ত্যাগ আরম্ভ হয়, তখনই প্রকৃত আধ্যাত্মিক উন্নতি আরম্ভ হয়। ভগবৎ প্রেমোন্মত্ততায় ইন্দ্রিয়বৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি জাত সব সুখ আপনা আপনিই নিষ্প্রভ হয়ে যায়। তখন সাধকের পক্ষে অনুষ্ঠানের আর আবশ্যকতা থাকে না, শাস্ত্রের কোন প্রয়োজন থাকে না; প্রতিমা, মন্দির, ভজনালয়, বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়, দেশ, জাতি—এই-সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ ভাব ও বন্ধন আপনা থেকেই চলে যায়। 

⬛ ⬛ ভক্তের বৈরাগ্য প্রেমপ্রসূত~~~ 
প্রাণহীন জড়— সে কি কখনও চৈতন্যবান্ আত্মাকে টানতে পারে? কখনই পারে না, কখনও পারবেও না। একটা সুন্দর মুখ দেখে একজন উন্মত্ত হল। গোটাকতক জড় পরমাণু কি তাকে পাগল করল? না, কখনই না। ঐসব জড় পরমাণুর আড়ালে ঐশ্বরিক প্রেমের লীলা বর্তমান। অজ্ঞ লোক তা জানে না।মানুষের মুখে, আকাশে, তারায় বা চন্দ্রে যে সৌন্দর্যের বিকাশ তা কোথা থেকে আসল? তা সেই ভগবানেরই সর্বব্যাপী সৌন্দর্যের আংশিক প্রকাশ মাত্র। শ্রুতিতে বলা হয়েছে, ‘তাঁরই প্রকাশে সকলের প্রকাশ।’ ভক্তির এই উচ্চভূমিতে দণ্ডায়মান হও। তা একেবারে তোমাদের ক্ষুদ্র আমিত্বকে ভুলিয়ে দেবে। ঈশ্বর-রূপ প্রেমসমুদ্রের ভক্তিজলে তখন ভক্তের হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সেখানে আর ছোটখাটো ভালবাসার স্থান হয় না। তাই ভক্তের বৈরাগ্য, ভগবানের প্রতি পরম অনুরাগ থেকে উৎপন্ন। এই বৈরাগ্য-লাভ হলে পরাভক্তির উচ্চতম শিখরে ওঠবার দ্বার খুলে যায়। তখন যেখানেই তিনি কোন সৌন্দর্য বা মহত্ত্ব দেখতে পান, সেখানেই তিনি অনুভব করেন—সবই সেই ভগবানের। 

⬛ ⬛ প্রেম ত্রিকোণাত্মক~~~ 
এই প্রেম-রূপ ত্রিভুজের একটি কোণঃ~ প্রেমে কোন দর কষাকষি বা কেনা বেচার ভাব নেই। প্রেমরূপ ত্রিকোণের দ্বিতীয় কোণঃ~ প্রেমে কোনরূপ ভয় নেই। প্রেমরূপ ত্রিকোণের তৃতীয় কোণঃ~ প্রেমে প্রতিদ্বন্দ্বীতা নেই। 

⬛ ⬛ ভক্তির প্রকাশভেদ~~~ 
প্রথম—‘শ্রদ্ধা’। তারপর ‘প্রীতি’। তারপর মধুরতম যন্ত্রণা ‘বিরহ’— প্রেমাস্পদের অভাবজনিত মহাদুঃখ। এই দুঃখ জগতে সকল দুঃখের মধ্যে মধুর—অতি মধুর। ‘ভগবানকে লাভ করিতে পারলাম না, জীবনে একমাত্র প্রাপ্তব্য বস্তু পেলাম না’ বলে মানুষ যখন অতিশয় ব্যাকুল হয় এবং সেজন্য যন্ত্রণায় অস্থির ও উন্মত্ত হয়ে ওঠে, তখনই বুঝতে হবে ভক্তের বিরহ-অবস্থা। মনের এই অবস্থা হলে প্রেমাস্পদ ব্যতীত আর কিছু ভাল লাগে না। 

⬛⬛ দিব্যপ্রেম~~~ 
সেই পুরুষোত্তম ব্যতীত জগতে ভালবাসার উপযুক্ত পাত্র আর কে আছে? তিনিই আমাদের একমাত্র প্রেমাস্পদ। দিব্যপ্রেমে মাতোয়ারা ভক্তগণের এই ভগবৎ প্রেমের ভাষা মূর্খরা বোঝে না—তারা কখনো বুঝবেও না। তারা কেবল জড়দৃষ্টিতে দেখে। তারা এই আধ্যাত্মিক প্রেমোন্মত্ততা কেমন করে বুঝবে? শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে কেমন করে লীলা করতেন, কেমন করে সবাই উন্মাদ হয়ে তাঁকে ভালবাসত, কেমন করে তাঁর কণ্ঠস্বর শোনবামাত্র  সেই ভাগ্যবতী গোপীরা সবকিছু ভুলে —জগৎ ভুলে, জগতের সকল বন্ধন, সাংসারিক কর্তব্য, সংসারের সুখদুঃখ ভুলে —তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসত, মানবীয় ভাষা তা প্রকাশ করতে অক্ষম। মানুষ— মানুষ, তুমি ভগবৎ প্রেমের কথা বলো, আবার জগতের সব অসার বিষয়ে নিযুক্ত থাকতেও তোমার আটকায় না; তোমার কি মন মুখ এক? ‘যেখানে রাম, সেখানে কি কাম থাকতে পারে? যেখানে কাম, সেখানে রাম থাকতে পারেন না; এই দুই কখনও একত্র থাকে না। যেমন আলো ও অন্ধকার কখনও একসাথে থাকে না।’ ‘হে প্রিয়তম, তোমার অধরের একটা মাত্র চুম্বন! যাকে তুমি একবার চুম্বন করেছ, তোমার জন্য তার তৃষ্ণা বেড়েই চলে। তার সব দুঃখ চলে যায়। সে তোমাকে ছাড়া আর সব ভুলে যায়।’ প্রিয়তমের সেই চুম্বন —তাঁর অধরের সাথে সেই স্পর্শের জন্য ব্যাকুলতা —যা ভক্তকে পাগল করে দেয়, যা মানুষকে দেবতা করে তোলে। ভগবান্ যাঁকে একবার তাঁর অধরামৃত দিয়ে কৃতার্থ করেছেন, তাঁর সমস্ত প্রকৃতিই বদলে যায়। তাঁর পক্ষে জগৎ অন্তর্হিত হয়। এটাই প্রেমোন্মত্ততার চরম অবস্থা।


  ভারতের সাধক ও সাধিকা



আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নূতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নূতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।

পুণঃপ্রচারে বিনীত 
     প্রণয় সেন
        প্রণয়
Share on Google Plus

About Indian Monk - Pronay Sen

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.

0 comments :

Post a Comment