‘দৈনন্দিন জীবনে ধ্যান ও শান্তি’ - স্বামী সোমেশ্বরানন্দ

আমি যখন কোন প্রিয়জনের মৃত্যুতে কাঁদি, তখন এই কান্নার আসল কারণ কি? আমার মনটাকে আমি দিয়ে রেখেছি বিভিন্ন লোকের ওপর - মা, বাবা, ভাই, বোন, বন্ধু, আত্মীয় ইত্যাদিকে। এরা যেন এক একটি থামের (Pillar) মতো, যে থামগুলির ওপর আমার মনটি দাঁড়িয়ে আছে। মানসিক দিক থেকে আমি তাদের ওপর নির্ভর করছি। কোন প্রিয়জন মারা যাওয়ার অর্থ আমার মানসিক নির্ভরতার ( Psychological Dependence ) একটি থাম ভেঙে যাওয়া। ফলে আমার মনের যে অংশটি নির্ভর করার কিছু পায় না, যেন শূন্যে ঝুলতে থাকে। এই শূন্যতাবোধই দুঃখের আকারে প্রকাশিত হয়।


প্রিয়জনের প্রতি আমাদের যে ভালোবাসা, সেটির রূপ কি ছিল? তাকে আমি যে ভালোবাসতাম সেই ভালোবাসাটা ছিল আত্মকেন্দ্রিক ( Self-Centred ), আমার সুখের একটি বিষয় ( Object of Pleasure ) ছিল সে। আমি শুধু ভালোবেসেই তৃপ্ত ছিলাম না, আমি চাইতাম সেও আমাকে ভালোবাসুক। অর্থাৎ এটি প্রকৃত ভালোবাসা ছিল না, ছিল একটি বিনিময়যোগ্য পণ্য। আর যে ভালোবাসায় প্রতিদানের আশা থাকে সেটি কখনও প্রকৃত ভালোবাসা হতেই পারে না, 
কারণ এটির পেছনে থাকে মানসিক নির্ভরতা। 
প্রিয়জনের মৃত্যুতে আমি কাঁদছি, আমি নিঃসহায় বোধ করি, আমার সুখের বিষয় চলে গেল বলে। এতদিন তাকে ভালোবাসতাম আমার নিজের জন্য। এখন কাঁদছি, তাও নিজের জন্য। 
আমার নিরাপত্তা, আমার সুখ, আমার চাহিদা, আমার নির্ভরতা - এগুলি চলে গেল বলেই কাঁদছি। 
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ, যাজ্ঞবল্কি - মৈত্রেয়ীর আলোচনা , ২:৪:৫: অংশের শঙ্করাচার্যকৃত ভাষায় দ্রষ্টব্যঃ ), মানসিক নির্ভরতাই মূল সমস্য। 
মানুষ এজন্যই নির্ভর করে তার স্ত্রী, সন্তান, বন্ধু আত্মীয়ের ওপর। মানুষ এভাবে নিরাপত্তা চায়, কিন্তু এ-জগতে প্রকৃত নিরাপদ বা চিরস্থায়ী কিছু আছে কি? প্রথমত, এ জগতে আছে মৃত্যু ----- স্ত্রীর, সন্তানের, মা-বাবার, ভাই বোনের, বন্ধু আত্মীয়দের।
দ্বিতীয়ত ------ সব কিছুই সব মানবিক সম্পর্কই পরিবর্তনশীল। আপনার মন না বদলালেও আপনার প্রিয়জনের মন বদলে যেতে পারে।
রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে ভুলে গিয়েছিলেন, দেসদিমোনার মৃত্যু হয়েছিল ওথেলোর হাতে।

এভাবে সমস্যাটিকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। এর সমাধানে ঠাকুর বলছেন, "সংসারে সকলকে নিয়ে থাকবে, যে তারা কত আপনার। কিন্তু মনে মনে জানবে তারা তোমার কেউ নয়।"
প্রশ্ন হতে পারে - সংসার দাঁড়িয়ে আছে ভালোবাসার ওপর; কেউ যদি মনে করে স্ত্রী সন্তান কেউ তার নয়, তবে তাদের ওপর তার ভালোবাসা থাকবে না এবং এ রকম হলে সংসার টিঁকবে না।

এই ধারণা কিন্তু ঠিক নয়। একটি অচেনা বাচ্চা ছেলেকে দেখলে আপনি তাকে আদর করতে যান কেন?  বাচ্চা ছেলে মেয়েকে সবাই ভালোবাসে কেন? দেখুন, কেন ভালোবাসে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, তখন ভালোবাসাটা যেন স্বত:স্ফূর্তভাবে উপস্থিত হয়। কেন? কারণ, আপনি ওই বাচ্চাটির কাছ থেকে কিছুই কামনা করেন না ------ টাকা নয়, সম্মান নয়, এমন কি আপনার ভালোবাসা পেয়েও শিশুটি যদি আপনাকে মারে তবুও আপনি রাগ করেন না। আপনার মন যখনই নিষ্কাম হয়, তখন অন্তরের ঐশ্বর্য ভালোবাসা নিজেই বেরিয়ে আসে। আবার দেখুন, আপনার নিজের ছেলে মেয়েরা যখন খুব ছোট ছিল তখন ওদের যতখানি তীব্রভাবে ভালোবাসতেন, ওরা যত বড় হতে থাকে, আপনার ভালোবাসাও যেন আগের থেকে একটু একটু কমে আসে। কেন এমন হয়? ওরা যখন ছোট থাকে, তখন আপনি ওদের কাছ থেকে কিছুই আশা করেন না। কিন্তু ওরা যত বড় হতে থাকে, আপনার প্রত্যাশাও ততই বাড়তে থাকে। আপনি তখন আশা করেন, আপনার ছেলে বাড়ির বাজারটা করে দেবে, ইলেকট্রিক বিলের টাকাটা জমা দিয়ে আসবে, আপনার মেয়ে অন্তত চা তৈরী করে দেবে, ভাতের জলটা চাপিয়ে দেবে, কাপড়টা ইস্ত্রি করে দেবে। এই প্রত্যাশা যতই বাড়তে থাকে, ভালোবাসা ততই কমতে থাকে। কিন্তু আপনি ওদের কোন সাহায্যের প্রত্যাশা না করেই যদি নিজের কর্তব্য করে যান, দেখবেন আপনার ভালোবাসা ঠিকই আছে। বর্তমানে সংসারে এত টেন্‌শন কেন, কনফ্রিক্‌ট কেন? কারণ এই দেনা-পাওনার ভাবটা বাড়ছে।
ছেলে বিয়ের পর মা বাবাকে সহ্য করতে পারছে না ! বৌদি বেকার দেবরকে দেখতে পারে না।
নিজের অবিবাহিতা বোনকে মানুষ গলগ্রহ ভাবে।



ঠাকুর তাই বলছেন, মনে মনে কাউকেই নিজের বলে না ভাবতে। অর্থাৎ অধিকারবোধের ( Possession ) ভাবটি না রাখতে। এই অধিকারবোধ থেকেই আসে প্রত্যাশা, আসে দেনা পাওনার চিন্তা। আবার সেই সঙ্গেই তিনি বলছেন, সংসারে সকলকে নিয়ে এমনভাবে থাকতে হবে যেন তারা কত আপনার‌। অর্থাৎ লোকব্যাবহারটি ঠিক রাখার ওপর তিনি জোর দিয়েছেন।

ধরুন, আপনি সল্টলেকে বেড়াতে গিয়েছেন, 
সুন্দর সুন্দর সব বাড়ী সেখানে, আর্কিটেক্‌চারাল ডিজাইনের অপূর্ব নির্দশন দেখে অবাক হবেন। বাড়ীগুলির সৌন্দর্য আপনি উপভোগ করতে পারবেন। কিন্তু আপনাকে যদি হঠাৎ বলা হয় ---- এগুলির মধ্যে যে-কোন একটি বাড়ী আপনি বেছে নিন, আপনাকে সেটি বিনা পয়সায় দেওয়া হবে ---- দেখবেন আপনার মন থেকে সৌন্দর্য বোধ চলে গেছে; তখন আপনি হিসেব করছেন এই বাড়ীটায় কটা ঘর আছে, ঐ বাড়ীটায় ঘরগুলির কার্পেট এরিয়া কত, সেই বাড়ীটার জানালা দক্ষিণমুখী কিনা, ইত্যাদি। কেন? কারণ অধিকারবোধের সঙ্গেই আসছে দেনা-পাওনার ভাব, ফলে অন্তরের ঐশ্বর্য সৌন্দর্যবোধ চলে যায়। 
হিমালয় পাহাড়, পুরীর সমুদ্র, দার্জিলিং-এ সূর্যোদয়, আকাশে চিলের অলসভাবে ওড়া ----- এগুলি দেখতে মানুষ ভালবাসে কেন? 
কারণ এগুলি দেখার সময় এগুলির ওপর মানুষের অধিকারবাধ আসে না, পাহাড়-সমুদ্র-সূর্য-চিল দেখার সময় ঐগুলিকে কেউ নিজের সম্পত্তি করতে চায় না। মন তখন নিষ্কামভাবে থাকে বলেই সৌন্দর্যবোধে মন ভরে ওঠে। ভালোবাসা, সৌন্দর্য ইত্যাদি ভাবগুলি অন্তরের ঐশ্বর্য। মানুষ যখন কিছু কামনা করে না, তখন অন্তরের এই ঐশ্বর্যগুলি স্বত:স্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসে। অন্যের ব্যবহারে দুঃখ পাওয়াঃ—
কেউ প্রশংসা করলে আমরা খুশি হই, গালাগালি দিলে রেগে যাই। কেন? কারণ আমরা আমাদের মনে নিজেদের এক-একটা ভাবমূর্তি (image) গড়ে তুলি। আমি নিজেকে সাধু বলে ভাবছি, আপনি নিজেকে অধ্যাপক ভাবছেন, তিনি নিজেকে এনজিনিয়ার ভাবছেন, রামবাবু নিজেকে ধনী ভাবছেন, শ্যামবাবু নিজেকে নেতা ভাবছেন, মিসেস বসু নিজেকে ক্লাস-ওয়ান অফিসারের স্ত্রী ভাবছেন। এবং শুধু নিজেই ভাব না, আমরা চাই অন্য লোকও এটি ভাবুক আমার সম্বন্ধে। এ জন্যেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই, বিখ্যাত হতে চাই, নতুন মডেলের গাড়ী কিনতে চাই, সুন্দর বাড়ী তৈরি করি।
এসব করি কেন? মানুষের প্রশংসা-হাততালি-সম্মান পাবার জন্যে। অর্থাৎ আমার অস্তিত্বকে আমি তখনই মূল্যবান মনে করি যখন অন্য
লোকে তার স্বীকৃতি দেয়। এভাবে পরনির্ভর হয়ে পড়ছি আমরা—আমাদের অস্তিত্ব নির্ভর করছে অন্যের হাততালির ওপর। এর কারণ আমাদের অবচেতন মনের দৈন্য, স্বীয় অন্তরের ঐশ্বর্যহীনতা। এই যে নিজের সম্বন্ধে ধারণা বা ইমেজ, একে আমরা রঙিন বা উজ্জ্বল করে তুলছি আমাদের শিক্ষাগত ডিগ্রি দিয়ে, চাকুরির পদ দিয়ে, নিজের টাকা সৌন্দর্য পাণ্ডিত্য দিয়ে, নিজের উচ্চপদস্থ আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্ক দিয়ে। এই ইমেজ আমাদের কাছে ব্যক্তিগত ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এর ওপর মানসিক দিক দিয়ে নির্ভর করছি।

         ‘দৈনন্দিন জীবনে ধ্যান ও শান্তি’          
 পরমপূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী সোমেশ্বরানন্দ
          ভারতের সাধক ও সাধিকা



আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নূতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নূতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।

ভারতের সাধক ও সাধিকা
     পুণঃপ্রচারে বিনীত 
           প্রণয় সেন
              প্রণয়
Share on Google Plus

About Indian Monk - Pronay Sen

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.

0 comments :

Post a Comment