স্বামীজির কাছে হিমালয় ছিল সর্বব্যাপী ভগবানের বিরাট প্রতিমা। হিমালয় বারে বারে আকর্ষণ করেছে বিবেকানন্দকে। সংকট মুক্তি, আশার আলোর সন্ধান পেয়েছেন এখানে। তিনি অনুভব করতেন হিমালয় তান ধরেছেন রাগরাগিণীর। শুনতেন অলকানন্দার স্রোতে কেদার রাগের আলাপ। দর্শন করেছিলেন বহু মহাত্মাকে। হিমালয়েই থাকাকালীন শুনলেন তাঁর বোনের মৃত্যুসংবাদ! অনুভব করলেন ভারতীয় নারীর দুর্দশা। এই হিমালয় ভ্রমণেই তিনি একদিন এক অতীন্দ্রিয় দর্শনের মাধ্যমে আর্যঋষিদের যুগের এক সন্ধ্যায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাঁর হিমালয় প্রেমের ফসল মায়াবতীর অদ্বৈত আশ্রম। বিদেশিনী ভক্ত মিসেস হ্যানসব্রোকে বলেছিলেন, ‘আমাকে আর কোনও দৃশ্য দেখাতে যেও না। আমি হিমালয় দেখেছি!’ লিখেছেন স্বামী বলভদ্রানন্দ।
স্বামীজির জীবনে আমরা দেখি যে, হিমালয় তাঁকে চিরকাল সম্মোহিত করে রেখেছে। আমরা জানি, শিশুকালে দুরন্ত স্বামীজিকে শান্ত করার জন্য মা ভুবনেশ্বরী দেবী তাঁর মাথায় জল ঢেলে দিয়ে জপ করতেন ‘শিব শিব শিব’, কখনও বা বলতেন, ‘এত দুষ্টুমি করলে শিব আর তোকে কৈলাসে যেতে দেবেন না।’
সব দুষ্টুমি ভুলে ‘বিলে’ তখন শান্ত হয়ে যেতেন!
পরবর্তীকালে নিবেদিতার কাছে স্বামীজি বলেছিলেন: তাঁর মা যে বলতেন শিবের কাছে ছেলে চেয়েছিলাম, তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন তাঁর এক ভূতকে— সেই কথা শুনতে শুনতে তাঁর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল যে, সত্যিই তিনি শিবের সহচর ছিলেন, কোনও অপরাধ করার জন্য শিব তাঁকে নির্বাসন দিয়েছেন।
তাই তিনি সংকল্প করেছিলেন, তাঁর সারা জীবনের চেষ্টা হবে আবার শিবের কাছে ফিরে যাওয়া।
সেইজন্য মা যখন তাঁর মাথায় জল ঢেলে ‘শিব শিব’ বলতেন, নির্বাসন পাছে আরও দীর্ঘ হয়ে যায়, সেই ভয়ে তিনি তখন শান্ত হয়ে যেতেন!
আবাল্য স্বামীজির শিবের প্রতি এই অদ্ভুত শ্রদ্ধা-বিশ্বাস ও ভালোবাসা ছিল।
নিবেদিতার কাছে আবেগপূর্ণ ভাষায় তিনি বলতেন: ‘He is the Great God, calm, beautiful and silent and I am His great worshipper’ (তিনিই সেই মহেশ্বর— শান্ত, সুন্দর এবং মৌন, আর আমি তাঁর পরম ভক্ত।)
ওই নিবেদিতার কাছেই তিনি ভবিষ্যৎ ভারতের মেয়েদের সম্বন্ধে বলেছিলেন: শত কাজের মধ্যেও যদি তারা মাঝে মাঝে সময় করে শিব নাম উচ্চারণ করে, তবেই তাদের যথেষ্ট পূজা অর্চনা হবে।
এতটাই ছিল তাঁর শিবের মহিমায় বিশ্বাস।
যদিও তিনি জানতেন, ভগবান সর্বব্যাপী সেই ভগবানেরই অন্যতম রূপ বলে শিবও সর্বব্যাপী, তবুও অধিকাংশ হিন্দুর মতো হিমালয়কে তিনি শিবের বিশেষ আবাসভূমি বলে মনে করতেন।
সেই কারণেই শিশুকাল থেকে তিনি হিমালয়ের প্রতি এক শ্রদ্ধাপূর্ণ দুর্জ্ঞেয় আকর্ষণ অনুভব করে এসেছেন।
যখন তিনি বিশ্বখ্যাত বিবেকানন্দ, পাশ্চাত্যে রয়েছেন এবং বক্তৃতায়, সংগঠনে, মানুষের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানে সারাক্ষণ ব্যস্ত— তখনও তিনি মাঝে মাঝে হিমালয়ের দুর্নিবার আকর্ষণ অন্তরে অনুভব করে বলে উঠেছেন: ‘আমার যদি দুটো পাখা থাকতো তবে আমি উড়ে হিমালয়ে চলে যেতাম।’
হিমালয়ের এই সম্মোহনকারী আকর্ষণ তিনি শৈশব থেকে অনুভব করে এলেও, ক্রমশ হিমালয়, শিব, ভারত, ভারতের চিরন্তন আদর্শ— সব একাকার হয়ে গিয়েছিল তাঁর কাছে।
হিমালয়ের পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে দীর্ঘদিন স্বামীজির মনে হয়েছে, সেখানকার নদী ও জলপ্রপাতগুলি কী যেন বলে চলেছে নিজেদের মধ্যে। পরে তিনি তাদের সেই ভাষার কিঞ্চিৎ ‘পাঠোদ্ধার’ করেছেন।
তিনি শুনতে পেয়েছেন, তারা নিরন্তর উচ্চারণ করে চলেছে ‘হর হর বম্ বম্, হর্ হর বম্ বম্’ ধ্বনি।
অলকানন্দার কুলুকুলু ধ্বনির মধ্যে স্পষ্ট শুনেছেন তিনি শিবের পরম প্রিয় কেদাররাগ।
হিমালয় এইভাবেই ধ্বনিময় বাণীময় চিন্ময় হয়ে বিরাজ করেছে তাঁর চারপাশে, যখনই তিনি হিমালয়ে বিচরণ করেছেন।
তিনি অনুভব করেছেন, হিমালয়ের আকাশে বাতাসে পর্যন্ত মহাদেবের চিরন্তন ধ্যানমূর্তি ওতপ্রোত হয়ে রয়েছে; পার্থিব কোনও ভোগসুখের চিন্তাই সেই ধ্যানকে ভাঙতে পারে না। দেবতাত্মা হিমালয়ের গোটাটাই স্বামীজির কাছে ছিল শিবালয়।
তবুও স্বামীজির সাধক ও কর্মজীবনের অধিকাংশই কেটেছে হিমালয় থেকে দূরে— সমতলে, দেশে এবং দেশের বাইরে। কারণ, একটা গোটা যুগকে পথ দেখাতে তাঁর আবির্ভাব।
দক্ষিণেশ্বরে যেদিন তিনি প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন, সেদিনই তাঁর প্রভু তাঁর দিব্য জন্ম-কর্মের ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন— ‘জানি আমি প্রভু, তুমি সেই পুরাতন ঋষি! নর-রূপী নারায়ণ। জীবের দুর্গতি নিবারণ করতে পুনরায় শরীর ধারণ করেছো।’
কাজেই, তিনি যে নির্বিকল্প সমাধির বৃহত্তম আনন্দকেও মানুষের যে কোনও প্রয়োজনের তুলনায় তুচ্ছ জ্ঞান করবেন এবং নিজের মহামূল্য স্বল্পপরিসর জীবনের সিংহভাগই ব্যয় করবেন লোকালয়ে, অবিশ্রাম কর্মে— তা বিবেকানন্দের কাছে সম্পূর্ণ প্রত্যাশিত।
কিন্তু এও আমরা দেখি, দৈবনির্দিষ্ট সেই লোককল্যাণ-কর্মের বোঝা যখনই একটু হালকা হওয়ার উপক্রম হয়েছে, তখনই তাঁর মনপ্রাণ আকুলিবিকুলি করে উঠেছে হিমালয়ে ফিরে যেতে, ঠিক যেমন কুণ্ডলীকৃত স্প্রিং সব সময় সুযোগ খোঁজে পূর্ণ দৈর্ঘ্যে ফিরে আসতে।
স্বামীজি প্রথম হিমালয়ে যান শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে। সেবার কাশী, বৃন্দাবন হয়ে তিনি পৌঁছন হিমালয় নিকটবর্তী হাতরাস শহরে। ট্রেনে করে গিয়েছিলেন বলে হাতরাস স্টেশনে দেখা হয় সহকারী স্টেশন মাস্টার শরৎচন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে।
এই শরৎচন্দ্রই পরবর্তীকালে স্বামী সদানন্দ রূপে রামকৃষ্ণ সংঘের রত্ন হয়ে উঠেছিলেন।
স্বামী সদানন্দ পরে বলতেন— ‘স্বামীজীর অদ্ভুত প্রেম-উজ্জ্বল তেজোদ্দীপ্ত চোখ দুটিই তাঁকে চিরতরে বেঁধে ফেলেছিল।’ Love at first sight কথাটা তিনি শুনেছিলেন, কিন্তু প্রথম উপলব্ধি করলেন স্বামীজিকে দেখে।
কয়েকদিনের মধ্যেই রেলওয়ের কাজে ইস্তফা দিয়ে পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর বেশে শরৎচন্দ্র চললেন স্বামীজির সঙ্গে।
হিমালয়ের চড়াই-উতরাই পথে চলতে গিয়ে শরৎচন্দ্র বুঝলেন, সন্ন্যাস জীবন কল্পনার চেয়েও আরও কত বেশি কঠিন! পথে দেখলেন তাঁরই মতো কোনও একজন পরিব্রাজক সন্ন্যাসী বাঘের শিকার হয়েছেন! তাঁর অর্ধভুক্ত দেহাংশ এবং ছিন্ন গেরুয়া পড়ে রয়েছে পথের উপর। স্বামীজি জিজ্ঞেস করলেন— ‘তোর ভয় করছে?’
শরৎচন্দ্র নিজের মনের দিকে চেয়ে নিজেই যেন বিস্মিত হলেন। ভয় পাওয়ারই তো কথা, কিন্তু ভয় তো পাননি! শরৎচন্দ্র উত্তর দিলেন: ‘না স্বামীজি, আপনি কাছে থাকলে কোন ভয় নেই।’
অভীঃমূর্তি এই গুরুকে এই যাত্রাতেই কিন্তু দেখেছেন, ভালোবাসার সাগর রূপে।
পার্বত্য পথে স্বামীজি এগিয়ে চলেছেন বলিষ্ঠ পদক্ষেপে, অনায়াসে। পেছনে কঠিন পিচ্ছিল পথে সদানন্দ চলেছেন টলমল করে। মাথায় তাঁর পুঁটলি। সেই পুঁটলির মধ্যে একজোড়া ভারী বুট। অনেক পিছিয়ে পড়েছেন তিনি। তাই দেখে স্বামীজি ফিরে এলেন। শিষ্যের পুঁটলিটি জোর করে কেড়ে নিয়ে নিজের মাথায় তুলে নিলেন, আর আরেকটি হাতে শিষ্যের ক্লান্ত দেহটিকে সযত্নে জড়িয়ে ধরে পথ চলতে লাগলেন!
পরবর্তীকালে এই ঘটনাটি স্মরণ করে স্বামী সদানন্দ অশ্রুবিসর্জন করতে করতে বলতেন, ‘আমি তাঁর কথা কী করে বলব? শুধু বলতে পারি, তিনি ছিলেন প্রেমময় প্রেমমূর্তি! আমি যখন এত দুর্বল হয়ে পড়েছি যে কোনও প্রকারে টলেমলে চলতে পারি, তখনও তিনি আমার সব জিনিস এমনকী জুতো পর্যন্ত নিজের কাঁধে বয়েছেন।’
শাস্ত্র বলেছে— মহাপুরুষরা তীর্থের তীর্থত্ব সম্পাদন করেন— ‘তীর্থী কুর্বন্তি তীর্থানি।’
হিমালয়ের প্রেক্ষাপটে স্বামীজির জীবনের এই অপরূপ ছবিটি সম্ভবত হিমালয়ের মহিমাকেই আর একটু বৃদ্ধি করেছে।
স্বামীজি সেবার হৃষীকেশে বেশ কিছুদিন ছিলেন।
এরপরে তিনি হিমালয়ে যান স্বামী অখণ্ডানন্দজির সঙ্গে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে। শ্রীশ্রীমা তখন সাময়িকভাবে লিলুয়ার কাছে ঘুসুড়িতে একটি ভাড়াবাড়িতে ছিলেন। তাঁরা দু’জনেই মায়ের কাছে গিয়েছিলেন আশীর্বাদ চাইতে।
মা দুজনকেই আশীর্বাদ করেছিলেন এবং অখণ্ডানন্দজিকে আলাদা করে বলে দিয়েছিলেন— ‘তোমার হাতে আমাদের সর্বস্ব দিলাম; তুমি পাহাড়ের সব অবস্থা জানো। দেখো, যেন নরেনের খাওয়ার কষ্ট না হয়।’ এটিই স্বামীজির সবচেয়ে দীর্ঘ পরিব্রজ্যা।
এরপর তিন বছর ধরে প্রায় সমগ্র ভারত পরিক্রমা করে তিনি ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে পাশ্চাত্যের উদ্দেশে যাত্রা করেন। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে হিন্দুধর্ম তথা ভারতবর্ষের জয়ধ্বজা উড্ডীন করে নিজের গুরুভাইদের মধ্যে আবার ফিরে আসেন ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে, ভারতখ্যাত বিশ্বখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দ রূপে। মঠ তখন বরানগর থেকে উঠে এসেছে ‘আলমবাজার মঠ’-এ।
১৮৯০ সালের এই হিমালয় যাত্রায় স্বামীজির অখণ্ডানন্দজিকে সঙ্গে নেওয়ার কারণ, এর আগে অখণ্ডানন্দজি তিব্বত ভ্রমণ করে এসেছেন।
বিভিন্ন বাধা বিঘ্নের মধ্য দিয়ে একাকী যেভাবে তিনি তিব্বত ভ্রমণ করে এসেছেন, সেইসব রোমহর্ষক কিছু বর্ণনা শুনে স্বামীজি বলেছিলেন: ‘তোর মতন লোকই আমার চাই হিমালয়ে যাওয়ার জন্য। ’
জুলাই ১৮৯০ এর শেষ সপ্তাহে তাঁরা দু’জনে বরানগর মঠ থেকে যাত্রা করলেন এবং ভাগলপুর, বারাণসী প্রভৃতি জায়গা হয়ে পৌঁছলেন নৈনিতালে।
সেখান থেকে তাঁরা পদব্রজে যাত্রা করলেন আলমোড়ার দিকে।
পথে মাঝে মাঝে স্বামীজি অখণ্ডানন্দজিকে বলতেন: ‘তুই রাস্তা দিয়ে যা, আমি একটু বনের ভিতর দিয়ে গিয়ে ওধারে তোর সঙ্গে মিলব।’ অখণ্ডানন্দজিও তাই করতেন।
একদিন এইভাবে একা একা রাস্তা ধরে যেতে গিয়ে অখণ্ডানন্দজি দেখলেন, বনের মধ্যে এক জায়গায় বেশ ফুল ফুটেছে, চারদিক দিব্য গন্ধে পূর্ণ আর সেখানে ঠাকুর ও স্বামীজি আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে বসে আছেন!
নৈনিতাল থেকে আলমোড়া যাওয়ার পথে স্বামীজির আরও কিছু অনুভূতি হয়েছিল যার দু-একটি তিনি অখণ্ডানন্দজিকে বলেছিলেন।
যেমন, স্বর্ণোজ্জ্বল অক্ষরে তিনি নানা মন্ত্র দর্শন করেছিলেন। বিভিন্ন দেবতার মন্ত্র কী এবং সেগুলির কী তাৎপর্য, তা তিনি এই সময় অখণ্ডানন্দজিকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
আলমোড়ার কাছাকাছি কাকরীঘাটে যখন তাঁরা পৌঁছন, তখন সেখানে একটি অশ্বত্থ গাছের নিচে স্বামীজির এক বিশেষ উপলব্ধি হয়।
ঘটনাটির সবিশেষ গুরুত্ব এখানে এই যে স্বামীজি স্বয়ং তাঁর ওই উপলব্ধিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং নিজের হাতে অখণ্ডানন্দজি ডায়েরিতে সেটি নোট করে রেখেছিলেন। অর্থাৎ তিনি চাননি তাঁর সেই উপলব্ধির কথা হারিয়ে যাক।
কাকরীঘাটে পৌঁছে পাহাড়ি নদী কোশির তীরে এক শিবমন্দিরের কাছে বড় হয়ে ওঠা বিশাল একটি অশ্বত্থ গাছ দেখে স্বামীজি মুগ্ধ হন।
ধ্যানের অনুকূল পরিবেশ বুঝে তাঁরা দু’জনে কোশি নদীতে স্নান করে অশ্বত্থ গাছটির নীচে বসে ধ্যানস্থ হয়ে যান।
এক ঘণ্টা পরে ধ্যান থেকে ব্যুত্থিত হয়ে স্বামীজি অখণ্ডানন্দজিকে বলেন— ‘এই গাছের নীচে একটা শুভ মুহূর্ত কেটে গেল; আজ একটা বড় সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। বুঝলাম সমষ্টি ও ব্যষ্টি (বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও অনুব্রহ্মাণ্ড) একই নিয়মে পরিচালিত।’
স্বামীজি তাঁর এই অনুভূতির কথা অখণ্ডানন্দজির কাছে রাখা নোট বইয়ে যেমন লিখে রেখেছিলেন, তা হল এই— ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও অণুব্রহ্মাণ্ড একই নিয়মে সংগঠিত। ব্যষ্টি জীবাত্মা যেমন একটি চেতন দেহের দ্বারা আবৃত, বিশ্বাত্মাও তেমনই চেতনাময়ী প্রকৃতির মধ্যে বা দৃশ্য জগতের মধ্যে অবস্থিত। শিবা শিবকে আলিঙ্গন করে আছেন।’
আলমোড়া রামকৃষ্ণ মঠ ও স্থানীয় গ্রামবাসীদের উৎসাহে স্বামীজি ও অখণ্ডানন্দজির স্মৃতিপূত এই কাকরীঘাট এখন সুন্দরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। যাঁরাই এখন উত্তরাখণ্ডে স্বামীজির স্মৃতির সঙ্গে জড়িত স্থানগুলিতে যান, তাঁরা কাকরীঘাট দর্শন না করে ফেরেন না।
আলমোড়ায় পৌঁছে স্বামীজি পথশ্রমে এবং খিদেয় প্রায় অজ্ঞান হয়ে এক জায়গায় শুয়ে পড়েছিলেন।
তখন এক মুসলমান ফকিরের দেওয়া একফালি শসা খেয়ে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। উঠে বসে ফকিরের হাত থেকে শসাটি নেওয়ার ক্ষমতাও স্বামীজির ছিল না। তিনি ফকিরকে বলেন, শসার ফালিটি তাঁর মুখে গুঁজে দিতে। ফকির জানায়, তিনি মুসলমান! স্বামীজি উত্তর দেন, ‘তাতে কী হয়েছে? আমরা কি তাই বলে পরস্পরের ভাই নই?’
স্বামীজি পরে বলতেন, ‘লোকটি বাস্তবিক সেদিন আমার প্রাণ রক্ষা করেছিল, কারণ আমি আর কখনও ক্ষুধায় অতটা কাতর হইনি।’
হিমালয় ভ্রমণে সর্বদাই স্বামীজির অমানুষিক পরিশ্রম হতো, পথশ্রম তো ছিলই তার সঙ্গে ছিল আহার ও নিদ্রার সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা বা অভাব।
তা সত্ত্বেও অভ্রভেদী হিমালয়ের ভাবগাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য দর্শনে তাঁর মন সব সময় অপার্থিব আনন্দে ভরপুর থাকত।
আলমোড়ায় থাকাকালেই স্বামীজি তাঁর ভগিনীর আত্মহত্যার খবর পান। এই ঘটনা স্বামীজিকে নিদারুণ আঘাত করে এবং ভারতীয় নারীজীবনের বেদনাপূর্ণ দিকটির সম্বন্ধে তাঁকে সচেতন করে তোলে। দুঃখ ভোলবার জন্য তিনি হিমালয়ের আরও নির্জন অংশে চলে যেতে চাইলেন। সেই উদ্দেশে গুরুভাইদের নিয়ে তিনি বদ্রীনারায়ণের পথে যাত্রা করলেন। কিন্তু কর্ণপ্রয়াগ পর্যন্ত পৌঁছে আর যেতে পারলেন না, কারণ দুর্ভিক্ষের জন্য সরকার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
স্বামীজি তখন রুদ্রপ্রয়াগের দিকে চললেন।
রুদ্রপ্রয়াগের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। চতুর্দিক নির্জন, সর্বত্র এক নিস্তব্ধ শান্তি বিরাজিত। কেবল মাঝে মাঝে পাখির কাকলি, ঝিল্লিরব এবং নদীর কুলুকুলু ধ্বনি। সেই ধ্বনির মধ্যে স্বামীজি নানা সুরের সন্ধান পেতেন এবং গুরুভাইদের তিনি তা বুঝিয়ে দিতেন। এখানেই তিনি একদিন বলেছিলেন, অলকানন্দা এখন কেদার রাগে বইছে। আবাল্য যে হিমালয়-দর্শনের স্বপ্ন তিনি সযত্নে লালন করে এসেছিলেন, রুদ্রপ্রয়াগেই তিনি তাকে প্রাণ-মন ভরে প্রথম দেখলেন। আরও কিছুদিন তাঁর রুদ্রপ্রয়াগে থাকার ইচ্ছা ছিল কিন্তু জ্বরাক্রান্ত হওয়ায় শিগগিরই তাঁরা শ্রীনগরে চলে গেলেন।
শ্রীনগরে স্বামীজি একমাস ছিলেন। অলকানন্দার তীরে একটি কুটিরে তাঁরা থাকতেন। স্বামীজি এখানে মাধুকরী করে জীবন কাটাতেন এবং গুরুভাইদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় উপনিষদ আলোচনা করতে করতে একেবারে দেশ, কাল ও শারীরিক অবস্থার ঊর্ধ্বে চলে যেতেন।
হিমালয়ের গুহায় তিনি আরও অনেক সাধু দেখেছেন যাঁরা সিদ্ধপুরুষ কিন্তু লোকসংসর্গ একেবারেই পছন্দ করেন না।
লোকসংসর্গে এড়িয়ে চলার জন্য তাঁরা গুহার চারপাশে নরকঙ্কাল ছড়িয়ে রাখতেন কিংবা লোক দেখলেই পাথর ছুড়তেন।
স্বামীজি এঁদের সম্বন্ধে বলতেন, ‘এঁদের তপস্যা, তীর্থযাত্রা বা পূজাদির কোনও প্রয়োজন নেই। তবে যে এঁরা তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ান ও তপস্যাদি কঠোর অনুষ্ঠান করেন, সে শুধু নিজ নিজ পুণ্যবলে লোককল্যাণ সাধনের জন্য।’
হিমালয়ের আরেকজন সাধুর পুণ্যদর্শন ও সঙ্গ স্বামীজির একটি মূল জীবনদর্শনে তাঁর স্বীয় আস্থাকে আরও দৃঢ় করে তুলেছিল। সাধুটির সৌম্যমূর্তি দেখেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি সত্যিই উন্নত পর্যায়ের সাধু। তারপরে তাঁর সঙ্গে আলাপ করে স্বামীজি যা জানলেন তাতে তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না। তিনিই সেই লোক যিনি পওহারি বাবার আশ্রমে চুরি করতে ঢুকেছিলেন। পওহারি বাবা জেগে ওঠায় তিনি চুরির জিনিস ফেলে রেখেই পালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পওহারি বাবা তাঁর পেছন পেছন ছুটে গিয়ে তাঁকে নারায়ণজ্ঞানে সম্বোধন করে তাঁর হাতে সেই সব জিনিস তুলে দেন। তারপরেই তাঁর নিজের চোরজীবনের প্রতি ধিক্কার আসে এবং তিনি সন্ন্যাসী হয়ে যান। বহু রাত পর্যন্ত স্বামীজি তাঁর সঙ্গে কথা বললেন এবং বুঝতে পারলেন, তাঁর সত্যিই সত্যলাভ হয়েছে। এই ঘটনাটি স্বামীজির মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। এই ঘটনাটি স্মরণ করেই পরবর্তীকালে বারবার বলেছেন, পাপীদের মধ্যেও সাধুত্বের বীজ লুকিয়ে থাকে।
এরপরে তিনি হিমালয়ে এসেছেন পাশ্চাত্য থেকে প্রত্যাবর্তনের পর, ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে। আমরা জানি যে, শিকাগো ধর্মমহাসভায় তাঁর অভূতপূর্ব সাফল্যের পর তাঁকে আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে মানুষের আহ্বানে ভারতের ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রচারে এতই ব্যস্ত থাকতে হতো যে সংবাদপত্রগুলি তাঁর নাম দিয়েছিল ‘সাইক্লোনিক হিন্দু মঙ্ক’— ঝঞ্ঝাসদৃশ হিন্দু সন্ন্যাসী। কিন্তু সেই ঝঞ্ঝাসদৃশ জীবনের মধ্যেও যতবার তিনি পুণ্যভূমি ভারতের কথা ভেবেছেন, ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে হিমালয়ও ততবারই তাঁর মানসপটে ভেসে উঠেছে। বিশেষত আল্পস পর্বতমালা তাঁকে বিশেষভাবেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে হিমালয়ের কথা। সেই পর্বতের উপরে খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসীদের একটি আশ্রম দেখে তাঁর মনে হয়েছে, ভারতেও হিমালয়ের শান্ত গম্ভীর ক্রোড়ে সন্ন্যাসীদের একটি আশ্রম গড়ে তুলতে হবে। তাঁর এই কল্পনারই ভবিষ্যৎ ফলশ্রুতি বর্তমানের মায়াবতীর অদ্বৈত আশ্রম, যা উত্তরাখণ্ডের চম্পাওয়াত জেলাতে অবস্থিত।
স্বামীজি বলেছেন, হিমালয় পর্বতমালা আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ স্মৃতিগুলির সঙ্গে জড়িত। ভারতের ধর্ম ও ইতিহাস থেকে যদি হিমালয়কে বাদ দেওয়া যায় তবে তার অতি অল্পই বাকি থাকবে।
সৌন্দর্যের বিষয়েও তাঁর মতে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দৃশ্যগুলি রয়েছে হিমালয়ের মহিমময় শৃঙ্গে।
মিসেস হ্যানসব্রো নাম্নী এক বিদেশিনী ভক্তকে তিনি একবার বলেছিলেন— ‘আমাকে আর কোন দৃশ্য দেখাতে যেও না। আমি হিমালয় দেখেছি!’ (Do not show me sights. I have seen the Himalayas!)
পাশ্চাত্য থেকে ফিরে স্বামীজি ১ মে ১৮৯৭ রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করলেন।
তার পাঁচ দিন পর (৬ মে) গুরুভাই স্বামী যোগানন্দজিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আলমোড়া যাত্রা করলেন।
পথে লখনউতে একদিন ছিলেন। সেখানে অনুরাগী বন্ধু ও ভক্তবৃন্দ তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। পরদিন ট্রেনে করে তিনি ও স্বামী যোগানন্দজি কাঠগোদাম স্টেশনে এসে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গুডউইন আলমোড়া থেকে চলে এসেছেন। গুডউইন এবং আরও কয়েকজন ভক্তের সঙ্গে তাঁরা তখন নৈনিতালের পথে আলমোড়া অভিমুখে চললেন। আলমোড়ার কাছাকাছি লোদিয়াতে এক বিরাট জনসঙ্ঘ স্বামীজিকে অভ্যর্থনা জানাল।
স্বামীজির জন্য তাঁরা একটা সুসজ্জিত ঘোড়া নিয়ে এসেছিলেন। স্বামীজিকে সেই ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে জনতা শোভাযাত্রা সহকারে অবিরাম জয়ধ্বনি করতে করতে আলমোড়া অভিমুখে এগিয়ে চলল।
আলমোড়ায় পৌঁছে দেখা গেল শহরের প্রতিটি গৃহদ্বার দীপমালায় উদ্ভাসিত এবং রাজপথগুলি মালা ও পতাকার দ্বারা সুশোভিত।
স্বামীজিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বাজারের এক অংশ জুড়ে একটা বৃহৎ মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছিল এবং স্বামীজি যখন ওই মণ্ডপ অভিমুখে যাচ্ছিলেন, তখন দু’পাশের বাড়িগুলি থেকে শত শত পুরনারী তাঁর মাথায় ফুল ও খই বর্ষণ করছিলেন।
সভামণ্ডপে পৌঁছে সকলের অভিনন্দনের উত্তরে স্বামীজি যখন ভাষণ দিতে উঠলেন তখন তিনি শুরুতেই হিমালয়ের শান্ত মহিমার কথা বললেন— ‘পাশ্চাত্যে আমি যে সামান্য কিছু কাজ করেছি, তার জন্য দয়া করে আপনারা প্রশংসা করেছেন। কিন্তু এখন আমার মন প্রাচ্য কি পাশ্চাত্য কোন দেশের কাজ সম্বন্ধে কিছু বলতে চাইছে না।
(আলমোড়ায় আসবার পথে) যতই এই পর্বতরাজের শিখরগুলি আমার চোখে পড়তে লাগলো ততই আমার কর্মপ্রবৃত্তি, বছরের পর বছর ধরে চলা আমার মস্তিষ্কের সমস্ত আলোড়ন —যেন শান্ত হয়ে এলো।...এই সেই ভূমি আমাদের পূর্বপুরুষরা শয়নে-স্বপনে যে ভূমির বিষয় ধ্যান করতেন, এই সেই ভূমি — যা ভারত জননী পার্বতী দেবীর জন্মভূমি! এই সেই পবিত্র ভূমি যেখানে ভারতের প্রত্যেক যথার্থ সত্যপিপাসু ব্যক্তি জীবনসন্ধ্যায় এসে জীবনের শেষ অধ্যায় সমাপ্ত করতে চায়।... এই সেই ভূমি— অতি বাল্যকাল থেকেই আমি যেখানে বাস করবার কল্পনা করে আসছি।’
তারপরে তিনি হিমালয়ের কোলে একটি আশ্রম স্থাপনের জন্য তাঁর যে একান্ত ইচ্ছাটি ছিল, সকলের কাছে সেটি ব্যক্ত করলেন—‘আমার মাথায় এখন হিমালয়ে একটি কেন্দ্র স্থাপন করবার সংকল্প আছে... এই হিমালয়ের সঙ্গে আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ স্মৃতিগুলো জড়িত।
যদি ভারতের ইতিহাস থেকে হিমালয়কে বাদ দেওয়া যায় তবে সেই ইতিহাসের প্রতি অল্পই অবশিষ্ট থাকবে। অতএব এখানে একটা কেন্দ্র চাইই চাই।
এই কেন্দ্র কর্মপ্রধান হবে না —এখানে নিস্তব্ধতা, শান্তি ও ধ্যানশীলতা অধিকমাত্রায় বিরাজ করবে; আর আমি আশা করি, একদিন না একদিন আমি একে কার্যে পরিণত করতে পারব।’
মাত্র দু’বছরের মধ্যেই স্বামীজির এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছিল।
এই সময় সঙ্গী যোগানন্দজি ছাড়াও স্বামীজির আরও কয়েকজন সন্ন্যাসী গুরুভাই তিনি আলমোড়া এসেছেন বলে বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন।
তাঁরা হলেন স্বামী নিরঞ্জনানন্দজি, স্বামী অদ্ভুতানন্দজি ও স্বামী বিজ্ঞানানন্দজি।
আলমোড়ায় কয়েকদিন থাকার পর স্বামীজি আলমোড়া থেকে ২০ মাইল দূরে অপেক্ষাকৃত শীতলতর স্থান দেউলধারে কয়েক সপ্তাহ ছিলেন।
সেখানে লালা চিরঞ্জীলাল শা-র একটি ফলের বাগান ছিল, সেখানেই তিনি থাকতেন।
এবার হিমালয় বাসের অনেকটা সময়ই তিনি এই দেউলধারেই কাটান। প্রথমে সেখানে যান ১৮ মে এবং একমাস থেকে আলমোড়ায় ফিরে আসেন ১৯ জুন। তারপরে আবার দেউলধার যান ১১ জুলাই এবং দু’সপ্তাহ থাকেন। আলমোড়াতে তিনি তিনটি বক্তৃতা করেছিলেন। তার মধ্যে জেলা স্কুলের সাধারণ সভায় হিন্দিতে বলেছিলেন, ‘বেদের উপদেশ: তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক’ এই বিষয়ে। এটিই স্বামীজির জীবনের প্রথম হিন্দি বক্তৃতা। ইংরেজি বক্তৃতাগুলির মতো তাঁর এই হিন্দি বক্তৃতাটিও উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। এই বক্তৃতাগুলি দেওয়ার সময়ই তিনি একদিন লক্ষ্য করেন, জনসভার ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন সেই মুসলমান ফকিরটি, যিনি পরিব্রাজক অবস্থায় ক্ষুধায় মুহ্যমান স্বামীজিকে একফালি শসা খাইয়ে বাঁচিয়েছিলেন।
স্বামীজি তৎক্ষণাৎ তাঁকে কাছে ডেকে এনে সবাইকে বললেন, ‘এই ফকিরই একদিন তাঁর প্রাণরক্ষা করেছিলেন। ফকির কিন্তু স্বামীজিকে চিনতে পারেননি। স্বামীজি সেই ফকিরকে কিছু অর্থও দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা আলমোড়ার রামকৃষ্ণ মঠ ওই মুসলমান ফকিরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় এখনও পর্যন্ত সাধ্যমতো চেষ্টা করে তাঁর উত্তরসূরিদের পাশে থাকতে।
২ আগস্ট স্বামীজি আলমোড়া ত্যাগ করেন। তিনি এই যাত্রায় কাশ্মীরেও গিয়েছিলেন এবং সেপ্টেম্বর মাসের ৮ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত শ্রীনগরে ছিলেন। কাশ্মীর সরকার একটি বজরা তাঁর ব্যবহারের জন্য দিয়েছিলেন। সেই বজরাতে তিনি থাকতেন এবং বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন লাটু মহারাজ এবং কয়েকজন সন্ন্যাসী।
স্বামীজির কাছে হিমালয় ছিল সর্বব্যাপী ভগবানের বিরাট প্রতিমা, যেটি সকলের কাছেই সুস্পষ্ট ও দৃষ্টিগোচর— যে প্রতিমাটি প্রকৃতি নিজের হাতে গড়েছেন। গীতার ‘বিভূতিযোগ’ অধ্যায়ে ভগবান যে যে বস্তুর মধ্যে তাঁর বিশেষ প্রকাশ আছে বলে স্বয়ং উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হিমালয়। ‘স্থাবরাণাং হিমালয়ঃ’— অচল বস্তুসমূহের মধ্যে আমি হিমালয় (গীতা ১০/২৫)।
হিমালয় তাই দেবতাত্মা। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যাঁরা ঈশ্বর বিশ্বাস করেন কিন্তু ঈশ্বর লাভ করেননি, হিমালয়ের গম্ভীর বিশালতার দিকে তাকিয়ে তাঁদের স্বততই মনে হয়, ভগবান বুঝি বা এমনই মহান, এমনই বিরাট, এমনই শান্তিময় আশ্রয়! যুগ যুগ ধরে হিমালয় তাই ভক্ত-সাধকদের কাছে ভগবানের স্বাভাবিক প্রতিমা রূপে প্রতিভাত হয়েছেন এবং হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে তাঁরা স্বতই ভগবানের প্রকাশ অনুভব করেছেন। স্বামীজি যখন হিমালয়ে তখন এক বিদেশি মেয়ে কালীঘাটের কালীমূর্তির সামনে ভক্তদের সাষ্টাঙ্গ প্রণতিকে বিশদ দৃশ্য বলে বর্ণনা করেন। তার মন্তব্য শুনে স্বামীজির শান্ত গম্ভীরস্বরে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এই পর্বতমালার সম্মুখে সাষ্টাঙ্গ হওয়া আর সেই প্রতিমার সম্মুখে সাষ্টাঙ্গ হওয়া কি একই কথা নয়?’
অর্থাৎ প্রতীক মহিমময় হয়, যার সে প্রতীক তাঁর মহিমার গুণে। কালীঘাটের কালীমূর্তি সেই বিরাট ভগবানের আংশিক প্রতীক। হিমালয়ও সেই ভগবানের প্রতীক এবং যত বড়ই সে হোক, সর্বব্যাপী বিরাট ভগবানের সে আংশিক প্রতীকই মাত্র। ভগবান চিরনমস্য। ভগবানের প্রতীক বলে হিমালয় নমস্য। একই কারণে কালীমূর্তি ও অন্যান্য প্রতিমাও নমস্য। স্বামীজি এরপরে আলমোড়ায় এসেছিলেন ১৮৯৮-এর মে মাসে। তখন নিবেদিতা ভারতে এসে গেছেন এবং স্বামীজির এই হিমালয় ভ্রমণের সঙ্গী হয়েছিলেন।
ভগিনী নিবেদিতা ছাড়াও সঙ্গে আরও ছিলেন স্বামী সারদানন্দ, স্বামী তুরীয়ানন্দ প্রমুখ সন্ন্যাসী ও মিস ম্যাকলাউড, মিসেস ওলিবুল প্রমুখ কয়েকজন বিদেশিনী ভক্ত মহিলা। স্বামীজির এবারকার হিমালয় ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নিবেদিতাকে ভারত চেনানো। এবার স্বামীজি আলমোড়া ছাড়াও গিয়েছিলেন তুষারতীর্থ অমরনাথ এবং দেবীতীর্থ ক্ষীরভবানীতে। তিনি অমরনাথ দর্শনে চলেছিলেন আর দশজন সাধুর মতো, তাঁদেরই সঙ্গে মিলেমিশে, তীর্থযাত্রীদের সমস্ত আচার নিয়ম তাদেরই মতো বা ততোধিক নিষ্ঠা সহকারে পালন করে। দিনে একবার মাত্র আহার করতেন, মন্ত্রজপে দীর্ঘকাল কাটাতেন। প্রবল শীত ও শারীরিক কষ্ট উপেক্ষা করে পুণ্য নদীসমূহে স্নান করতেন, কখনও মৌন থাকতেন কখনও বা সৎপ্রসঙ্গ করতেন।
এবারকার হিমালয় ভ্রমণের সময়ও তাঁর মাথায় ছিল সেই স্বপ্নের অদ্বৈত আশ্রমের কথা। স্থানটি হবে সমুদ্রতল থেকে হাজার সাতেক ফুট উঁচু। যেখানে তাঁর পাশ্চাত্য শিষ্যরা সহজেই পৌঁছে যেতে পারবে। সেখানে তাঁর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিষ্যরা একসঙ্গে বসবাস করে অদ্বৈততত্ত্ব শিক্ষাগ্রহণ করবে। শিক্ষা শেষে ভারতীয়রা যাবে পাশ্চাত্যে বেদান্ত প্রচার করতে এবং পাশ্চাত্যের শিষ্যরা ভারতের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করবে। কখনও এককভাবে, কখনও বা সেভিয়ার দম্পতির সঙ্গে একত্রে তিনি ওই আশ্রমের জন্য হিমালয়ের বিভিন্ন জায়গায় জমির সন্ধান করেছেন। ধরমশালা, মারী, শ্রীনগর, আলমোড়া প্রভৃতি অনেক অঞ্চলে খুঁজেছেন কিন্তু উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাননি।
অবশেষে সেভিয়ার দম্পতিই সমুদ্রতল থেকে ৬-৭ হাজার ফুট উঁচুতে ‘মায়াবতী’-র জমিটির সন্ধান পান। স্থানটি অবিলম্বে কিনে ফেলা হয় এবং ১৮৯৯-এর ১৯ মার্চ শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথির দিন অদ্বৈত আশ্রমের প্রতিষ্ঠা হয়। স্বামীজি সেই সময় বেলুড় মঠে। ক্রমশ সাধুরা এসে অদ্বৈত আশ্রমে বসবাস করতে থাকেন।
আলমোড়া থেকে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকার স্থায়ী অফিসও মায়াবতীতে স্থানান্তরিত করা হয়।
জায়গাটির নিজস্ব সৌন্দর্যই অতুলনীয়, তার ওপর সেখান থেকে নন্দাদেবী, ত্রিশূল প্রভৃতি শৃঙ্গও দেখা যায়। অদ্বৈত আশ্রমের ভাবাদর্শ ও উদ্দেশ্য বোঝার জন্য স্বামীজি একটি প্রসপেক্টাস লিখে দেন।
তাতে তিনি অন্যান্য কথার মধ্যে এই কথাগুলি লিখেছিলেন: ‘অদ্বৈতই একমাত্র মতবাদ যা মানুষকে সম্পূর্ণ কুসংস্কার মুক্ত করে এবং পূর্ণাঙ্গ স্বাধিকার প্রদান করে। হিমালয়ের সর্বোচ্চ প্রদেশে এই আশ্রম করার কারণ এই হিমালয়েই সর্বপ্রথম অদ্বৈততত্ত্ব উদ্গীত হয়েছিল।’
স্বামীজি তাঁর স্বপ্নের অদ্বৈত আশ্রমে একবারই মাত্র এসেছিলেন। ১৮৯৯-এর মাঝামাঝি সময় তিনি দ্বিতীয়বার আমেরিকা যান, ফিরে আসেন ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর। ফিরে এসে শুনলেন মাস দেড়েক আগে (২৮ অক্টোবর ১৯০০) ক্যাপ্টেন সেভিয়ার দেহত্যাগ করেছেন। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য স্বামীজি অনতিলম্বে মায়াবতী যাত্রা করেন এবং ২৯ ডিসেম্বর ভোররাত্রে ট্রেনে কাঠগোদাম পৌঁছন। কাঠগোদাম থেকে মায়াবতী ৬৫ মাইল— হাঁটা পথে তিন দিনের রাস্তা। স্বামীজি কাঠগোদাম পৌঁছনোর মাত্র ঘণ্টা কয়েক আগে স্বামী বিরজানন্দজি মায়াবতী থেকে অতি কষ্টে কুলি ও ডাণ্ডি জোগাড় করে অমানুষিক পরিশ্রমে তিন দিনের পার্বত্যপথ দু’দিনে অতিক্রম করে স্বামীজিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাঠগোদামে পৌঁছে ছিলেন। পথশ্রমে বিরজানন্দজির জ্বর এসে গিয়েছিল। ২৯ তারিখে বিশ্রাম করে ৩০ ডিসেম্বর ভোরে স্বামীজিকে নিয়ে বিরজানন্দজিরা মায়াবতী রওনা হলেন। প্রথম দিন আবহাওয়া ভালো ছিল এবং ১৭ মাইল অতিক্রম করে একটি ডাকবাংলোয় পৌঁছে সেদিনের মতো যাত্রা শেষ করলেন। পরদিন রওনা হওয়ার একটু পরেই প্রবল বৃষ্টি ও তুষারপাত শুরু হল। হিমালয়ের দুর্যোগের সঙ্গে স্বামীজি পরিচিত ছিলেন আর অসুবিধের মধ্যেও তিনি মনকে প্রফুল্ল রাখতে জানতেন। আনন্দ করতে করতে, কখনও সুইজারল্যান্ডের গল্প করতে করতে কখনও বা বাহকদের সঙ্গে মশকরা করতে করতে চললেন। সে রাতটা তাঁরা রাস্তার ধারে একটি ছোট দোকানে আশ্রয় নিলেন। অপরিসর অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে কারও ঘুম হল না, কোনওমতে শুয়ে রইলেন। তখন স্বামী বিরজানন্দজি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিলেন — সেদিন ৩১ ডিসেম্বর ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ রাত, পরদিনই শুরু হবে বিংশ শতাব্দী!
যুগাচার্য বিবেকানন্দ, বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দ, ভারত তথা জগৎবাসীর জীবনপথের দিশা দেখান বিবেকানন্দ— দুই শতাব্দীর সন্ধিক্ষণের রাতটি কাটালেন কোনও আশ্রমে বা গৃহে নয়, শত শত পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর মতো হিমালয়ের বুকে, পথ-পার্শ্বে!
পরদিন এক ফুট গভীর বরফের উপর দিয়ে তাঁরা যাত্রা করলেন এবং ৩ জানুয়ারি ১৯০১ (অর্থাৎ কাঠগোদাম থেকে যাত্রা করার ৫ দিন পর) দুপুরবেলায় তাঁরা মায়াবতী পৌঁছলেন। মায়াবতীতে স্বামীজি ছিলেন দু’সপ্তাহ।
যে কদিন ছিলেন প্রতিটি মুহূর্তই ছিল আনন্দে পরিপূর্ণ। চার বছর আগে পাশ্চাত্য থেকে ফিরে স্বামীজি যখন শরীর সারানোর জন্য দার্জিলিং গিয়েছিলেন, তখন ১৯ মার্চ ১৮৯৭ তারিখে শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে তিনি একটা সংস্কৃত চিঠি লিখেছিলেন, যার দুটি ছত্রের বঙ্গানুবাদ ছিল এরকম— ‘আমার মনে হয় নগাধিরাজ হিমালয়ের তুষারমণ্ডিত শিখরগুলি মৃতপ্রায় মানুষকেও পুনরুজ্জীবিত করে তোলে এবং শ্রমজনিত ক্লান্তিও কিছুটা দূর করে দেয়।’
মায়াবতীতে এসেও স্বামীজি শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলেন।
৬ জানুয়ারি মায়াবতী থেকে মিসেস বুলকে তিনি লিখেছেন, ‘এই জায়গাটি খুব, খুবই সুন্দর, আর এরা (আশ্রমবাসীরা) একে অত্যন্ত মনোরম করে তুলেছে। কয়েক একরের বিশাল জমি আর তাকে খুব সুন্দরভাবে রক্ষা করা হয়েছে।.... হিমালয়ে বেশ ভালো আছি।.... চারদিকে ছয় ইঞ্চি গভীর বরফ, সূর্য উজ্জ্বল ও মহীয়ান এবং মধ্যাহ্নে এখন আমরা বাইরে বসে আছি, বই পড়ছি। চারদিকেই বরফ। কিন্তু বরফ থাকা সত্ত্বেও শীত এখানে বেশ মৃদু। বাতাস শুষ্ক ও স্নিগ্ধ এবং জল অতি চমৎকার।’
কিন্তু এই মায়াবতীতেই এবার ঘটেছিল সেই মহাঘটনা, যা স্বামীজি ও শ্রীশ্রীমা উভয় চরিত্রের হীরকদ্যুতি বহন করে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ইতিহাসে চিরকালের মতো উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। মায়াবতীর সব কিছুই স্বামীজির ভালো লেগেছিল, শুধু একটি জিনিস তাঁকে একদিন রুষ্ট করে তুলেছিল।
একটি ঘরে গিয়ে দেখলেন দুই তরুণ সন্ন্যাসী, যাদের একজন তাঁর দীক্ষিত ও আরেকজন শ্রীশ্রীমায়ের, এবং দু’জনেরই সন্ন্যাসদীক্ষা তাঁরই কাছে, তাঁরা সেই ঘরে ঠাকুরের একটি প্রতিকৃতি বসিয়ে নিয়মিতভাবে ফুল, ধূপ নিবেদন করে চলেছেন।
স্বামীজি নিয়ম করেছেন, অদ্বৈত আশ্রমে নির্গুণ নিরাকার অদ্বৈত সাধনাই হবে। কোনও ছবি মূর্তি পটের পুজো এখানে স্থান পাবে না, সেসব এখানে রাখাও যাবে না। কাজেই, হোক না সে তাঁর চির-আরাধ্য, প্রাণ-মন-জীবন স্বরূপ শ্রীরামকৃষ্ণের অর্চনা, স্বামীজি ওই দুই সাধুর ঘরে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতিকৃতি স্থাপিত দেখে অত্যন্ত অসন্তোষ প্রকাশ করলেন।
স্বামীজি রুষ্ট হয়েছেন দেখে দুই সাধু অনতিবিলম্বে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতিকৃতি সরিয়ে দিলেন।
কিন্তু বিরাট সংশয় থেকে গেল তাঁদের মনে। নির্গুণ নিরাকার অদ্বৈত সাধনার জন্য এই অদ্বৈত আশ্রম, সে কথা তাঁরা বোঝেন।
কিন্তু যিনি স্বামীজির জীবনের সর্বস্ব, যিনি স্বামীজির গুরু, তাঁর জীবনে অদ্বৈতবোধ জাগিয়েছেন যে শ্রীরামকৃষ্ণ, যিনি এই সঙ্ঘের উৎস এবং সর্বস্ব —তাঁর প্রতিকৃতিও রাখা যাবে না? এইটুকু ব্যতিক্রম হবে না তাঁর ক্ষেত্রেও? এটা তাঁরা মেনে নিতে পারেননি।
কিন্তু সাহসেও কুলায়নি যে স্বামীজিকে এই সংশয়ের কথা সরাসরি বলবেন।
আমরা জানি স্বামীজির দেহত্যাগ হয় ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই।
সন্ন্যাসীদ্বয়কে এত তাড়না করছিল ওই মানসিক দ্বন্দ্ব যে, তার কয়েকদিন পরে ওই জুলাই মাসেই তাঁরা শ্রীশ্রীমাকে সম্পূর্ণ ঘটনাটি জানিয়ে তাঁর মতামত জানতে চাইলেন। এক অদ্ভুত উত্তর দিলেন মা! জানালেন, ‘নরেন ঠিকই করেছে। আমাদের গুরু যিনি, তিনি তো অদ্বৈত। তোমরা সেই গুরুর শিষ্য— তখন তোমরাও অদ্বৈতবাদী। আমি জোর করিয়া বলিতে পারি— তোমরা অবশ্য অদ্বৈতবাদী।’
শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর পতি, গুরু ও ঈশ্বর। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের শক্তি। কতবার বলেছেন তিনি, শ্রীরামকৃষ্ণ আর তিনি অভেদ। সেই শ্রীরামকৃষ্ণের পুজো অদ্বৈত আশ্রমে ‘নরেন’ চিরতরে বন্ধ করে দিল অদ্বৈততত্ত্বকে ‘পাখির চোখ’ করে, আর স্বামীজির সেই সিদ্ধান্তকে পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছেন তিনি! ‘রামকৃষ্ণগতপ্রাণা’ হয়েও? সাধারণ বুদ্ধিতে এর ব্যাখ্যা চলে না।
রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সাহিত্যের প্রখ্যাত গবেষক শংকরীপ্রসাদ বসু এই প্রসঙ্গে যথার্থই মন্তব্য করেছেন— ‘সারদা দেবীর এই বক্তব্য আমাদের চমকিত নয়, একেবারে স্তম্ভিত করে দেয়।...
আমাদের লৌকিক বুদ্ধিতে এ বস্তু অলৌকিক।
এ জিনিস একমাত্র শ্রীরামকৃষ্ণ-পত্নীর পক্ষেই করা সম্ভব।’ (শতরূপে সারদা, পৃষ্ঠা ১৮৭)
আবার ফিরে আসি, মায়াবতীস্থিত স্বামীজিতে।
মায়াবতীতে থাকাকালীনই স্বামীজি একদিন বলেছিলেন— ‘জীবনের শেষ ভাগে সমস্ত জনহিতকর কাজ ছেড়ে এখানে আসব আর গ্রন্থ রচনা ও সংগীতালাপ করে দিন কাটাব।’ স্বামীজির এই ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি।
১৮ জানুয়ারি ১৯০১ তারিখে স্বামীজি মায়াবতী থেকে কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা করেন। এই তাঁর শেষ হিমালয় দর্শন, এই তাঁর প্রথম ও শেষ মায়াবতী দর্শন।
শিকাগো বক্তৃতার কয়েক মাস পরে যখন তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে, ঝঞ্ঝার মতো আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বক্তৃতা করে চলেছেন, তখনও তিনি অধ্যাপক রাইটকে লিখেছিলেন— ‘আমি কখনো প্রচারক ছিলাম না, কখনো হবও না— আমার স্থান হিমালয়ে।’ ১৮৯৭ এর ১১ মে আলমোড়ায় তিনি বলেছিলেন— ‘আমার জীবনের একান্ত বাসনা, ঋষিরা যেখানে বাস করেছেন, দর্শনের যেখানে জন্ম হয়েছে, সেই পর্বতরাজের কোলে আমার জীবনের শেষ দিনগুলি কাটাব।’
দ্বিতীয়বার আমেরিকা যাওয়ার পর মেরি হেলকে লিখেছিলেন— ‘হিমালয়ের আশ্রম থেকে (অর্থাৎ মায়াবতী আশ্রম থেকে) যখনই আমি মিসেস সেভিয়ারের কোনও চিঠি পাই, তখনই ইচ্ছা হয়, সেখানে উড়ে চলে যাই। প্রতিনিয়ত প্লাটফর্মে বক্তৃতা করে, অবিরত ঘুরে বেড়িয়ে আর নিত্যনতুন মুখ দেখে আমি একেবারে ক্লান্ত।’
এরকম আরও অনেক পত্রাংশ উদ্ধৃত করা যায় যেগুলিতে তিনি বারবার হিমালয়ের কোলে বিশ্রাম নেওয়ার আকুতি প্রকাশ করেছেন। শেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা সিস্টার ক্রিস্টিনকে লেখা ২৭ ডিসেম্বর ১৮৯৯ তারিখের চিঠিটির অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি। এই চিঠি লেখার ন’মাস আগে মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিন্তু স্বামীজি তখনও মায়াবতী দেখেননি। এই চিঠিতে তিনি বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন, তাঁর কল্পনার হিমালয়বাস জীবনের চিত্রটি।
‘আমি হিমালয়ে একটা ছোট্ট জায়গা কিনব, একটা গোটা পাহাড়, ধরো ছয় হাজার ফুট উঁচুতে, যেখান থেকে চিরতুষারের অপূর্ব দৃশ্য দেখা যাবে। আর অবশ্যই থাকবে ঝর্ণা আর ছোট হ্রদ। আর সেডার— হিমালয়ের সেডারের বন! আর থাকবে ফুল, চতুর্দিকে শুধু ফুল! আমার একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর থাকবে; মাঝখানে থাকবে আমার সবজি বাগান, যেখানে আমি নিজে সবজি ফলাবো; আর....আর... আমার বই থাকবে!... আধ্যাত্মিক, জাগতিক সব রকম কাজ শেষ করে দিয়ে আমি অবসর নেব।’
কিন্তু কিছু পরে ওই চিঠিতেই স্বামীজি লিখেছেন দার্শনিক সুরে— ‘অদ্ভুত... নিজের ব্যক্তিগত সুখ নিয়ে আমার সব স্বপ্নই খালি ভেস্তে যায়, অথচ অন্যের কল্যাণের ব্যাপারে আমার সব কল্পনা ফলবেই ফলবে।’
তাঁর হিমালয় বাসের কল্পনা সম্পর্কেও একথা সত্য।
জগতের প্রয়োজনে হিমালয়ের বুকে অদ্বৈত আশ্রম স্থাপনের যে পরিকল্পনা স্বামীজির ছিল, তা বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে স্বামীজির জীবনকালেই।
কিন্তু হিমালয়ের কোলে স্বপ্নের অবসর জীবন কিংবা শেষ শয্যা— কোনওটিই স্বামীজির ভাগ্যে ঘটেনি!
মিস ম্যাকলাউডকে একটি চিঠিতে নিবেদিতা লিখেছেন (তারিখ ৯ অক্টোবর ১৮৯৯), তাঁকে স্বামীজি বার বার বলতেন, ‘হিমালয়ে চলে এসো এবং সমস্ত অনুভূতির ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজেকে উপলব্ধি কর। নিজেকে এইভাবে জানার পর তুমি আকাশের বজ্রের মতো শক্তিধর হয়ে জগতের উপরে নেমে আসতে পারবে।
আমার সেই সব লোকের উপর কোনও বিশ্বাস নেই যারা বলে, আমার কথা কি কেউ শুনবে?
এখনও পর্যন্ত এরকম কখনও হয়নি যে, যার সত্যিই প্রচার করবার মতন কিছু আছে, জগৎ অগ্রাহ্য করতে পেরেছে তার কথা শুনতে। নিজের শক্তির উপর ভর করে উঠে দাঁড়াও। পার না এরকম করতে? চলে এসো হিমালয়ে এবং এই শিক্ষা লাভ করো!’
স্বামীজি নিজেও নিশ্চয়ই এটিই করেছিলেন।
সেটিই তাঁর মহাশক্তিধর বাণী ও কর্মসমূহের মূলে।
আকর গ্রন্থাবলী:
The Complete Works of Sister Nivedita, Vol.I/যুগনায়ক বিবেকানন্দ : স্বামী গম্ভীরানন্দ/ স্বামী অখণ্ডানন্দ: স্বামী অন্নদানন্দ /The Complete Works of Swami Vivekananda/ Letters of Sister Nivedita/ Swami Vivekananda in the West: New Discoveries/The Life of Swami Vivekananda, Volume II, Advaita Ashrama/ শতরূপে সারদা।
0 comments :
Post a Comment