দিব্য-আলোক ধ্যান ওঁ স্বং ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার


মানুষকে দীর্ঘজীবী করাই হঠযোগের উদ্দেশ্য।
স্বাস্থ্যই মুখ্য ভাব, এটাই হঠযোগীদের একমাত্র লক্ষ্য। 'আমার যেন রোগব্যাধি না হয়' --- এটাই হঠযোগীর দৃঢ়সঙ্কল্প; তাঁর রোগব্যাধি হয়ও না; তিনি দীর্ঘজীবী হন; শতবর্ষ জীবিত থাকা তাঁর পক্ষে কিছুই নয়। দেড়শো বছর বয়সে তিনি পূর্ণ যুবক ও সতেজ থাকেন, তাঁর একটি কেশও শুভ্র হয় না; কিন্তু এই পর্যন্তই। বটগাছও কখনো কখনো পাঁচ হাজার বছর জীবিত থাকে, কিন্তু ওটা বটগাছই থেকে যায়, তার বেশি কিছু নয়। দীর্ঘজীবী মানুষ একটি সুস্থকায় প্রাণী, এইমাত্র। হঠযোগীদের দুই-একটি সাধারণ উপদেশ খুব উপকারী। সকালে ঘুম থেকে উঠে, যদি নাক দিয়ে জল টানা হয়, তাহলে তোমাদের মস্তিষ্ক বেশ পরিষ্কার ও শীতল থাকবে। তোমাদের কখনই সর্দি লাগবে না। নাক দিয়ে জল পান করা কিছু কঠিন নয়, অতি সহজ। নাক জলের ভিতর ডুবিয়ে নাক দিয়ে জল টানতে থাক, গলার মধ্যে দিয়ে ক্রমশঃ জল আপনা-আপনি ভিতরে যাবে। 
আসন সিদ্ধ হলে কোন কোন সম্প্রদায়ের মতে নাড়ীশুদ্ধি করতে হয়। রাজযোগের অন্তর্গত নয় বলে অনেকে এটার আবশ্যকতা স্বীকার করেন না। কিন্তু যখন ভাষ্যকার শঙ্করাচার্যের ন্যায় প্রমাণিত ব্যক্তি এটা করার বিধান দিয়েছেন, তখন আমি মনে করি, এটা উল্লেখ করা উচিত। আমি শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ভাষ্য হতে এ-বিষয়ে তাঁর মত উদ্ধৃত করবো --- 'প্রাণায়াম দ্বারা যে-মনের ময়লা ধুয়ে গেছে, সেই মনই ব্রহ্মে স্থির হয়। এইজন্যেই শাস্ত্রে প্রাণায়ামের বিষয় লেখা হয়েছে। প্রথমে নাড়ীশুদ্ধি করতে হয়, তবেই প্রাণায়াম করবার শক্তি আসে। 
পদ্মাসন, সুখাসন, সিদ্ধাসনে মেরুদণ্ড খাড়া করে বসে, ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ডান নাকের ছিদ্র চেপে ধরে বাম নাক দ্বারা যথাসাধ্য বায়ু গ্ৰহণ বা পূরক করতে হবে, পরে মধ্যে বিন্দুমাত্র সময় না নিয়ে বাম নাক বন্ধ করে ডান নাক দিয়ে বায়ু ত্যাগ বা রেচক করতে হবে‌‌। পুনরায় ডান নাক দিয়ে বায়ু গ্ৰহণ করে বাম নাক দিয়ে বায়ু রেচক করতে হবে।
ধারাবাহিক ভাবে চারবার অর্থাৎ সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা ও রাতে এই চারটি সময়ে এই প্রক্রিয়া তিনবার অথবা পাঁচবার অভ্যাস করলে এক পক্ষ অথবা এক মাসের মধ্যে নাড়ীশুদ্ধি হয়; তারপরে প্রাণায়ামে অধিকার হবে।
অভ্যাস একান্তই আবশ্যক।

তুমি প্রতিদিন অনেকক্ষণ বসে আমার কথা পড়তে পার। কিন্তু অভ্যাস না করলে এক বিন্দুও অগ্রসর হতে পারবে না। সবই সাধনের উপর নির্ভর করে। প্রত্যক্ষনুভূতি না হলে এ-বিষয়ে সকল তত্ত্ব কিছুই বোঝা যায় না। নিজে অনুভব করতে হবেই হবে,
কেবল ব্যাখ্যা বা মত শুনলেই চলবে না।

সাধনের অনেক বিঘ্ন আছে। প্রথম বিঘ্ন ব্যাধিগ্রস্ত দেহ ---- শরীর সুস্থ না থাকলে সাধনের ব্যাতিক্রম হবে। এজন্য শরীর সুস্থ রাখতে হবে। কিরূপ খাদ্যভ্যাস করি, কাজকর্ম করি এ-সকল বিষয়ে বিশেষ যত্ন ও মনোযোগ অবশ্যক। শরীর সবল রাখবার জন্য সর্বদা মনের শক্তি প্রয়োগ কর ----
ব্যস্, শরীরের জন্য আর কিছু করবার অবশ্যক নেই। স্বাস্থ্যরক্ষা উদ্দেশ্যসাধনের একটি উপায় মাত্র ----- এটা যেন আমরা কখনো না ভুলি। যদি স্বাস্থ্যেই উদ্দেশ্য হত, তবে তো আমরা পশুতুল্য হতাম। পশুরা প্রায়ই অসুস্থ হয় না।
চিত্তবৃত্তি-নিরোধের নামই যোগ --- 'যোগ' এক প্রকার বিজ্ঞান, যার সাহায্যে আমরা চিত্তের বিভিন্ন বৃত্তিতে রূপান্তরিত হওয়া বন্ধ করতে পারি। এই যোগের নাম অষ্টাঙ্গযোগ, কারণ এর প্রধান অঙ্গ আটটি।
যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান এবং সমাধি।

প্রথম --- যম। যোগের এই অঙ্গটি সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এইটি সারা জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করবে। এটি আবার পাঁচ ভাগে বিভক্ত :
(১) কায়মনোবাক্যে হিংসা না করা।
(২) কায়মনোবাক্যে লোভ না করা।
(৩) কায়মনোবাক্যে পবিত্রতা রক্ষা করা।
(৪) কায়মনোবাক্যে সত্যনিষ্ঠ হওয়া।
(৫) কায়মনোবাক্যে বৃথা দান গ্রহণ না করা (অপরিগ্ৰহ)।


দ্বিতীয় --- নিয়ম। শরীরের যত্ন, স্নান, পরিমিত আহার ইত্যাদি।


তৃতীয় --- আসন। মেরুদণ্ডের উপর জোর না দিয়ে কটিদেশ, স্কন্ধ ও মাথা ঋজুভাবে রাখতে হবে। 

চতুর্থ --- প্রাণায়াম। প্রাণবায়ুকে আয়ত্ত করবার জন্য শ্বাসপ্রশ্বাসের সংযম।

পঞ্চম --- প্রত্যাহার। মনকে বহির্মুখ হতে না দিয়ে
অন্তর্মুখ করে কোন জিনিস বোঝবার জন্য বারংবার আলোচনা।


ষষ্ঠ --- ধারণা। কোন এক বিষয়ে মনকে একাগ্র করা। 

সপ্তম--- ধ্যান। কোন এক বিষয়ে মনের অবিচ্ছন্ন চিন্তা।

অষ্টম -- সমাধি। জ্ঞানের আলোক লাভ করাই আমাদের সকল সাধনার লক্ষ্য।




যোগীরা বলেন, শরীরের মধ্যে সাতটি পদ্ম বা নাড়ীচক্র আছে। উর্দ্ধশক্তি কণ্ঠে, অধোশক্তি গুহ্যদেশে এবং মধ্য-শক্তি নাভিতে অবস্থিত। আর যিনি এই তিন শক্তির বাইরে তাকেই নিরঞ্জন ব্রহ্ম বলে। গুহ্যদেশে মূলাধার চতুর্দল, লিঙ্গমূলে স্বাধিষ্ঠান ষড়দল, নাভিতে মণিপুর দশদল, হৃদয়ে অনাহত দ্বাদশদল, কন্ঠে বিশুদ্ধ ষোড়শদল, ভ্রূমধ্যে আজ্ঞা দ্বিদল এবং মস্তকে সংস্রার সহস্রদল পদ্ম আছে। আর মেরুদণ্ডের বামভাগে ইড়া, দক্ষিণভাগে পিঙ্গলা ও মধ্যে সুষুম্না নাড়ী আছে। ঐ সুষুম্না নাড়ী মূলাধার থেকে যথাক্রমে ছটি পদ্ম ভেদ করে ব্রহ্মস্থানে সহস্রদলে গিয়ে মিশেছে। কিন্তু সুষুম্নার রাস্তা বন্ধ থাকে যতক্ষণ না কুণ্ডলিনীশক্তি জাগ্রত হয়। কুলকুণ্ডলিনী আত্মার জ্ঞানশক্তি, চৈতন্যরূপিণী, ব্রহ্মময়ী। তিনি সকল জীবের মধ্যে মূলাধার পদ্মে ঘুমন্ত সাপের মতো যেন নির্জীবভাবে রয়েছেন ---- যেন ঘুমুচ্ছেন। তিনি যোগ, ধ্যান, সাধনভজনাদির দ্বারা জাগ্ৰত হন। মূলাধারে সেই শক্তি যখন জেগে উঠে সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে দিয়ে ক্রমান্বয়ে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞাচক্র ভেদ করে সহস্রদলে পরমশিব বা পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হন, তখন উভয়ের সংযোগ থেকে যে পরমামৃত ক্ষরণ হয়, তা পান করে জীব সমাধিস্থ হয়। তখনই জীবের চৈতন্য হয়, আত্মস্বরূপের জ্ঞান হয়। তখন জ্যোতিদর্শন, ইষ্টমূর্তি দর্শন প্রভৃতি অনেক আশ্চর্য আধ্যাত্মিক অনুভূতি সব হয়ে থাকে। গুরু ও পরমেশ্বরের কৃপায় সাধকের সুকৃতিবলে কখনো কখনো তিনি আপনা হতেই অথবা অল্প আয়াসে জেগে থাকেন। সেই নির্বিকল্প সমাধি-অবস্থায়, ঠাকুর বলতেন, সাধারণতঃ একুশ দিনের বেশি শরীর থাকে না, জীব পরমাত্মায় বা পরব্রহ্মে লীন হয়ে যায়। 
সাধক যদি এই ছয় চক্রকে ভেদ করতে পারেন তিনি চক্রাতীত ও নমস্য। শরীরের উর্দ্ধদিক হল ব্রহ্মলোক। এবং শরীরের নীচের দিক হল পাতাললোক। এই শরীর বৃক্ষের মত কিন্তু এর উর্দ্ধদিক হল সেই বৃক্ষের মূল স্বরূপ এবং নিম্নদিক হল সেই বৃক্ষের শাখা স্বরূপ।
হৃদয়ে প্রাণবায়ু, গুহ্যদেশে অপাণবায়ু, নাভিদেশে সমান বায়ু, কণ্ঠে উদানবায়ু, দেহের ত্বকে ও সারা দেহ জুড়ে ব্যান বায়ু অবস্থিত। নাগ বায়ু উর্দ্ধপান হতে আগত এবং কূর্ম্মবায়ু তীর্থ দেশে আশ্রিত।  কৃকর বায়ু মানসিক ক্ষোভে, দেবদত্ত বায়ু হাই তুললে এবং ধনঞ্জয় বায়ু গভীর চিৎকার করলে নিবেশিত হয়ে সাম্য রক্ষা করে। এই দশ প্রকার বায়ু নিরালম্ব (অবলম্বন শূন্য) এবং যোগীগণের যোগ সম্মত।  আমাদের শরীরের বাহ্যত নবদ্বার প্রত্যক্ষ করা যায় এগুলি হল দুটি চোখ, দুটি কান, দুটি নাসারন্ধ্র, মুখ, গুহ্য ও লিঙ্গ এবং দশম দ্বার হল মন।
ঈড়া, পিঙ্গলা এবং সুষুম্না এই তিনটি নাড়ী উর্দ্ধগামিনী; গান্ধারী, হস্তি জিহ্বা ও প্রসবা এই তিনটি নাড়ী দেহের সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত আছে। শরীরের দক্ষিণ অঙ্গে অলম্বুষা ও যশা এই দুটি ও বাম অঙ্গে কুহু ও শঙ্খিনী এই দুটি নাড়ী ব্যবস্থিত। এই দশ প্রকার নাড়ী হতেই শরীরে নানা নাড়ী উৎপন্ন হয়েছে এবং বাহাত্তর হাজার প্রসূতিকা নাড়ী শরীরের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।  যে যোগী এই সমস্ত নাড়ী গুলিকে জানেন তিনি যোগ লক্ষণ যুক্ত হয়ে যান এবং জ্ঞাননাড়ী হতেই যোগীগণ সিদ্ধিলাভ করে থাকেন। আমাদের শরীরের মধ্যে আবার অসংখ্য নাড়ী আছে, তার মধ্যে ১৪টি প্রধান। এগুলো হলো- ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, সরস্বতী, বারূণী, পূষা, হস্তিজিহ্বা, যশস্বিনী, বিশ্বোদরী, কুহূ, শঙ্খিনী, পরদ্বিণী, অম্লম্বুষা ও গান্ধারী।



কূহূ : কুহূনাড়ি জননেন্দ্রিয়ের সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন করে। এর অবস্থান সুষম্নার বাম দিকে।
বিশ্বোদরা : ইড়া ও সুষম্নার মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই নাড়ী অবস্থিত। এই নাড়ি উভয় নাড়ীর সমান্তরলাভাবে বিস্তৃত।
গান্ধারী : সুষম্নার বাম দিককার সহযোগী স্নায়ুমণ্ডলীর মধ্যে এই নাড়ী অবস্থিত। বাম চোখের প্রান্তের তলদেশ থেকে বাম পা পর্যন্ত এই নাড়ী অবস্থিত।
হস্তীজীহ্বা : সুষম্নার সম্মুখভাগে এই নাড়ী অবস্থিত। বাম চোখের প্রান্তভাগ থেকে বাম পায়ের বুড়ো আঙুল পর্যন্ত এই নাড়ী অবস্থিত।
শঙ্খিনী : আর আর শঙ্খিনী নাড়ী দেহের মলাদি নির্গমনে সহায়তা করে।
জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মাঝখানে অবস্থিত কুন্দস্থান থেকে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, কুহূ, শঙ্খিনী প্রভৃতি প্রধান নাড়ীগুলোর উৎপত্তি হয়েছে। এদের মধ্যে কুহূনাড়ী জননেন্দ্রিয়ের সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন করে আর শঙ্খিনী নাড়ী দেহের মলাদি নির্গমনে সহায়তা করে। এই কুন্দস্থানেই কুলকুণ্ডলিনী নিদ্রিত সাপের আকারে বিরাজ করছেন।
তবে যাঁরা জগদগুরু, আচার্যকোটী বা ঈশ্বরকোটী, যাঁরা জগতের হিতের জন্যে কোন বিশেষ ঐশ্বরিক উদ্দেশ্য সাধন করবার জন্যে দেহধারণ করেন, তাঁরা ব্রহ্মানন্দও তুচ্ছ করে জাগ্রত কুণ্ডলিনী শক্তিকে ঐ পথ দিয়ে সহস্রার (মস্তক) হতে অনাহতচক্রে (হৃদয়ে) নামিয়ে এনে "ভাবমুখে" থাকেন, অর্থাৎ দ্বন্দ্বাতীত পরমার্থিক ( Absolute ) ও ব্যবহারিক ( Relative ) জ্ঞানের মধ্যে ওঠানামা করে থাকেন ও হাজার হাজার জীবকে অবিদ্যার মোহ থেকে উদ্ধার করেন। স্বামীজি বলেছেন, যথারীতি শাস্ত্রীয় বিধান ও বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে না গিয়েও
ক্বচিৎ কখনো কোন কোন মহাপুরুষের 'কুণ্ডলিনীশক্তি' আপনা আপনি জাগ্রত হয়ে ওঠে ---- হঠাৎ সত্যলাভের মতো। যেমন, পথে চলতে চলতে কোন লোক হোঁচট খেয়ে দেখলে যে, একখানা পাথর সরে গেছে ও তার নিচে কি যেন
ঝকঝক করছে। পাথরখানা উঠিয়ে দেখলে নিচে ঘড়া ঘড়া মোহর রয়েছে --- সেইরকম।
কিন্তু তাঁরা যেমন জগতের হিত করেন, তেমনি তাঁদের মনের সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামির দ্বারা জগতের অহিতও করে থাকেন। উচ্চৈঃস্বরে সমবেতভাবে নাম-সংকীর্তনাদির সময় অনেকে ভাবের উচ্ছ্বাসে কাঁদতে কাঁদতে ও নাচতে নাচতে সংজ্ঞাহীন হয়। তাদেরও 'কুণ্ডলিনীশক্তি' ক্ষণেকের জন্যে কতকটা জেগে ওঠে, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া ভয়ানক হয়। প্রায়ই দেখা যায় তাদের কু-অভ্যাস চরিতার্থ করবার ইচ্ছা, বা নিজের লোকের কাছে ভক্ত ও ধার্মিক বলে জাহির করে মানযশ লাভ করবার বাসনা খুব প্রবল হয় ও শেষে তারা কপটাচারী, ভণ্ড হয়ে দাঁড়ায়।
সূর্যের আলোতেই যেমন লোকে সূর্যকে দেখে, প্রদীপ জ্বেলে নয়, "তেমনি ভগবানের কৃপাতেই তাঁর দর্শন লাভ হয়, মানুষের ক্ষুদ্র শক্তিতে নয়।" তবে মেঘ এসে সূর্যকে ঢেকে ফেললে আর দেখা যায় না। তেমনি অবিদ্যা বা মায়া ভগবানকে দেখতে দেয় না। সাধনভজন, প্রার্থনাদির ঝড়ে সেই মেঘকে উড়িয়ে দেয় ও তিনি প্রকাশিত হন। সাধনভজন তাঁর দর্শনের হেতু নয়, কারণ তিনি  স্বপ্রকাশ। তারা কেবল আবরণ, বাধাবিঘ্ন মোচন করে।


° গুহ্যদেশে মূলাধার চতুর্দল ( Muladhara Chakra ) - Root Chakra - ( Red )

°° লিঙ্গমূলে স্বাধিষ্ঠান ষড়দল ( Svadhishthana Chakra ) - Sacral chakra - ( Orange )

°°° নাভিতে মণিপুর দশদল ( Manipura Chakra ) - Solar Plexus chakra ( Yellow )

°°°° হৃদয়ে অনাহত দ্বাদশদল ( Anahata Chakra ) - Heart chakra - ( Green )

°°°°° কন্ঠে বিশুদ্ধ ষোড়শদল - ( Vishuddha Chakra ) - Throat Chakra - ( Blue )

°°°°°° ভ্রূমধ্যে আজ্ঞা দ্বিদল ( Ajna Chakra ) - Third Eye chakra ( indigo )

°°°°°°° মস্তকে সংস্রার সহস্রদল - ( Sahasrara Chakra ) - Crown chakra ( violet )

যোগশাস্ত্র মতে 'কুলকুণ্ডলিনী শক্তি' হচ্ছে সমস্ত শক্তির আধার। প্রাচীনকালের সিদ্ধিপ্রাপ্ত যোগী-ঋষিরা মানবদেহ ও মনের কুণ্ডলিত শক্তি-উৎস সম্পর্কে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন,
সে মত অনুসরণ করেই যুগ যুগ ধরে সাধকমহাপুরুষেরা যোগসাধনায় ব্যাপৃত থেকে এই শক্তিকে জাগরিত করে সিদ্ধিলাভ করেছেন।
বিমুক্তিসোপান গ্রন্থে বলা আছে-
  গুহ্যেলিঙ্গে তথা নাভৌ হৃদয়ে কণ্ঠদেশকে।
ভ্রূমর্ধ্যহেপি বিজানীয়াৎ ষটচক্রান্তু ক্রমাদিতি।।
অর্থাৎ ভ্রূমধ্যে, কণ্ঠদেশে, হৃদয়ে, নাভিমূলে, লিঙ্গদেশে ও গুহ্যস্থানে ষটচক্র বিরাজ করেন।



° মূলাধার চক্র : যে শক্তি এই ব্রহ্মান্ডের মধ্যে রয়েছে, সেই একই শক্তি এই শরীরের মধ্যেও রয়েছে। যথা পিণ্ডে তথাই ব্রহ্মাণ্ডে। শক্তির মূখ্য আধার হলো মূলাধার চক্র। মূলাধার চক্রকে জাগ্রত করার ফলে 'কুণ্ডলিনী শক্তি' ঊর্ধ্বগামিনী হয়ে যায়। এটাই হল 'কুণ্ডলিনী জাগরণ'।
যেমন সমস্ত জায়গায় তার বিছানো থাকে এবং বাল্ব বা ফ্যান ইত্যাদি লাগানো হয় এবং এদের নিয়ন্ত্রণ একটা মূল সুইচের উপর থাকে। যখন মূল সুইচ অন্ করা হয় তখন সব যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ হয়ে যাবার জন্য চারিদিক আলোকিত হয়ে ওঠে। ঠিক সেইরকমই মূলাধার চক্রের সন্নিহিত 'কুণ্ডলিনী শক্তি' জাগ্রত হবার ফলে, অন্য চক্রগুলিও জেগে ওঠে ও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে। এই চক্রে রয়েছে সকল নাড়ীর মূলবিন্দু। জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মাঝখানে অবস্থিত স্থানকে বলা হয় কুন্দস্থান।
এই কুন্দস্থান থেকে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, কুহূ, শঙ্খিনী প্রভৃতি প্রধান প্রধান নাড়ীগুলো উৎপন্ন হয়েছে। এই চক্রে সকল শক্তির আধার বিদ্যমান থাকে। এই শক্তিকে বলা হয় 'কুলকুণ্ডলিনী'। কুন্দস্থানে এই 'কুলকুণ্ডলিনী' নিদ্রিত সাপের আকারে বিরাজ করে। শরীরের পদ্মসূত্রের মতো সূক্ষ্ম আদ্যাশক্তি ও প্রাণশক্তির মূল 'কুলকুণ্ডলিনী শক্তি' কুন্দস্থানে ঘুমিয়ে আছেন। সেই মত অনুসরণ করে যোগীরা এই 'কুণ্ডলিনী শক্তি'কে জাগরিত করে সিদ্ধিলাভ করার চেষ্টা করে থাকেন।
এই মূলাধার প্রদেশেই মুখব্যাদান করে ব্রহ্মদ্বারে সর্পাকৃতি কুলকুণ্ডলিনীর অধিষ্ঠান। এখানকার বীজমন্ত্র হলো "লম্"। এই বীজের ঠিক নীচে একটি ত্রিকোণ আছে। সেখানেই সুপ্তভাবে 'কুণ্ডলিনী' বিরাজ করেন। একটি ধূসর লিঙ্গকে সাড়ে তিন পাকে জড়িয়ে তিনি সুপ্তভাবে থাকেন নিদ্রিতরূপে।
এই শক্তি যতক্ষণ নিদ্রিত থাকে ততক্ষণ মানুষও পশুর মত থাকে।
তার উত্তরণের শুরু হয় এই শক্তি জাগ্রত হলে। এখান থেকেই সুষুম্না নাড়ীর উদ্ভব ঘটে। এর বাঁ দিক থেকে ওঠে ইড়া নাড়ী এবং ডানদিক থেকে পিঙ্গলা নাড়ী। ইড়া নাড়ী চন্দ্র্স্বরূপা, পিঙ্গলা নাড়ী সূর্যস্বরূপা এবং সুষুম্না নাড়ী চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি স্বরূপা।
এই চক্রের চারটি পাঁপড়িনির্দেশ করে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ। এখান থেকেই সবার সাধনার শুরু। এর তত্ত্ব হলো পৃথিবী এবং এর ইন্দ্রিয় ঘ্রানেন্দ্রিয়।
সুষুম্নার এই সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথই মুক্তির পথ। মুক্তির এই পথ দিয়েই 'কুণ্ডলিনী'কে উর্ধ্বদিকে চালিত করতে হয়।
'কুণ্ডলিনী'র অবস্থান সম্বন্ধে সিদ্ধ-যোগীদের বক্তব্য হচ্ছে ---- ‘মেরুদণ্ডের নিম্নদেশে যে মূলাধার চক্র আছে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই স্থানটি হচ্ছে প্রজননশক্তি বীজের আধার। একটি ত্রিকোণ মণ্ডলে একটি ছোট সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে- যোগীরা এঁকে এই প্রতীকে প্রকাশ করেছেন। এই নিদ্রিত সর্পই 'কুণ্ডলিনী'। এঁর ঘুম ভাঙানোই হচ্ছে রাজযোগের লক্ষ্য।’
মহাসর্প অনন্ত যেমন রত্ন-নিধিসমাকীর্ণা পৃথিবীর একমাত্র আধার, তেমনি 'কুণ্ডলিনী শক্তি' সব শক্তির আধার। ঐ কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরিতা হলে শরীরে ষটচক্রস্থিত অখিল পদ্ম ও গ্রন্থি ভেদ হয়ে যাওয়ায় প্রাণবায়ু সুষুম্নাচ্ছিদ্র দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে।
প্রাণায়াম অভ্যাসে যা বিশেষ প্রয়োজন।
প্রণয়মূলক চিন্তা বা পাশব-কার্য থেকে যে যৌনশক্তি উত্থিত হয়, তাকে উর্ধ্বদিকে মানব শরীরের মহাবিদ্যুৎ আধার মস্তিষ্কে প্রেরণ করতে পারলে সেখানে সঞ্চিত হয়ে যৌনশক্তি ‘ওজঃ’  আধ্যাত্মিক শক্তিলাভে সাহায্য করে।
এই ‘ওজঃ’ শক্তি হচ্ছে মানুষের মনুষ্যত্ব -- একমাত্র মনুষ্যশরীরেই এই শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব।
যার ভেতর সমস্ত পাশব যৌনশক্তি ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়েছে, তিনি মহাপুরুষ বা দেবতার পর্যায়ে উন্নীত হন।
যোগীরা মনে মনে কল্পনা করেন যে এই কুণ্ডলিনী সর্প সুষুম্না পথে স্তরে স্তরে চক্রের পর চক্র ভেদ করে মস্তিষ্কের সহস্রধারে উপনীত হয়। মনুষ্য শরীরের শ্রেষ্ঠ শক্তি যৌন-শক্তি যে পর্যন্ত না ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়, সে পর্যন্ত নারী বা পুরুষ কেউই ঠিক ঠিক আধ্যাত্মিক জীবন লাভ করতে পারে না।


আমাদের স্নায়ুরজ্জুর প্রধান ধারক মেরুদণ্ড মস্তিষ্কের নিম্নাংশ থেকে বের হয়ে গুহ্যদেশে এসে শেষ হয়েছে। যোগ-শাস্ত্রকারীদের মতে মেরুদণ্ডের বাঁদিকে ইড়া, মধ্যে সুষুম্না ও ডানদিকে পিঙ্গলা নাড়ী বিরাজমান। আমাদের সঞ্চারণমান প্রাণবায়ু ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্যে দিয়ে চক্রাকারে সতত আবর্তিত হচ্ছে। সুষুম্না একটি অতি সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথ- মেরুদণ্ডের পথে যার অবস্থান। সুষুম্না নাড়ীর এই প্রাণময় পথে ছয় স্থানে ছয়টি চক্র বিরাজ করছে, যাকে ষটচক্র বলা হয়। এগুলি হলো :
°° স্বাধিষ্ঠান চক্র : মূলাধার চক্রের উপর ( ১ থেকে ১.৫ ইঞ্চির উপর ) পেরুর পাশে, নাভিচক্রের নীচে এই চক্রের অবস্থান।
°°° মণিপুর চক্র : নাভিদেশের কেন্দ্রে এই চক্রের অবস্থান। এই স্থানে অসীম এবং শক্তিশালী তেজ অবস্থান করে। এই তেজকে মণির সাথে কল্পনা করে এর নামকরণ করা হয়েছে মণিপুরকচক্র।
°°°° অনাহত চক্র : হৃদপিণ্ড বরাবর নাভিপদ্মের উপরে মেরুদণ্ড সংলগ্ন অঞ্চলে এই চক্রটি অবস্থিত। যোগীদের মতে, এই চক্রের মাধ্যমে যোগীরা অনাহত নাদ শুনতে পান। মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান এবং মণিপুর চক্রকে জাগ্রত এবং সুস্থ রাখতে হলে এই চক্রকে সর্বদা জাগিয়ে রাখতে হবে। এই চক্রের ধ্যান করলে প্রেম, করুণা, সেবা এবং সহানুভূতির মতো দিব্যগুণের বিকাশ হয়।
মহাঋষী ব্যাসদেবও এই হৃদয় চক্রকে ধ্যান করবার জন্যে অনুপ্রাণিত করতেন।
°°°°° বিশুদ্ধিচক্র : এর স্থান মেরুদণ্ড সংলগ্ন কণ্ঠমূল বরাবর। যোগীরা মনে করেন, এই চক্রের মাধ্যমে মানুষ শুদ্ধ হয়। এই চক্রের ধ্যান করলে এবং এঁকে জাগ্রত করলে সাধক মহাজ্ঞানী, নিরোগ, শোকহীন আর দীর্ঘজীবী হয়।
°°°°°° আজ্ঞাচক্র : এই চক্রটি দুই ভ্রূরুর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। যোগীদের মতে— এই চক্র থেকে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদির অনুভূতি নিয়ন্ত্রিত হয়। এই চক্রের খুব কাছেই আজ্ঞাচক্রের উপরেই রয়েছে মনস ও সোম নামক দুটি ক্ষুদ্র চক্র। যোগীদের মতে এই চক্রের মাধ্যমে গুরু আজ্ঞা বা নির্দেশ আসে। এই কারণে এর নাম আজ্ঞাচক্র। কপালভাতি অনুলোম-বিলোম এবং নাড়ী শোধন ইত্যাদি প্রাণায়াম দ্বারা প্রাণ তথা মনকে স্থির করবার পর অটোনোমিক এবং ভলান্টারি নার্ভ সিস্টেম শান্ত সুস্থ এবং সন্তুলিত হয়ে যায়। সম্পূর্ণ নাড়ী তন্ত্র আজ্ঞাচক্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। এই আজ্ঞাচক্রকে জাগ্রত করবার পর নাড়ী সংস্থান সম্পূর্ণরূপে সুস্থ এবং বলিষ্ঠ হয়ে যায়। মূলাধার চক্র থেকে ইড়া, পিঙ্গলা এবং সুষম্না পৃথক পৃথক ভাবে উপরদিকে প্রবাহিত হয়ে এই জায়গায় সঙ্গম প্রাপ্ত হয়। এই জন্য আজ্ঞাচক্রের স্থানটিকে 'ত্রিবেনী' বলা হয়।
ইড়াকে গঙ্গা, পিঙ্গলাকে যমুনা এবং দুজনকে একসাথে মধ্যবর্তী নাড়ী সুষম্নাকে নিয়ে সরস্বতী বলা হয়। এই ত্রিবেণী এই চক্রতে এসে সঙ্গম করে তাই এঁকে দ্বিদল চক্র, পিত্তরাজ তৃতীয় নেত্র বা জ্ঞানচক্ষুও বলা হয়।
এখানে স্নান করে সাধক সমস্ত রকম পাপ থেকে
অর্থাৎ ত্রিতাপ যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধ হয়ে পরমগতি লাভ করে বা ঈশ্বরপ্রাপ্তি হয়। 
এই ত্রিবেণী সঙ্গম বাইরে নয় অথচ আমাদের ভিতরেই আছে।
তাই আজ্ঞাচক্রের মধ্যে সন্নিহিত ত্রিবেণী সঙ্গমে মনকে সম্মোহিত করে ভগবানের প্রতি ভক্তি দেখে জ্ঞানের গঙ্গায় ডুব দিয়ে ধ্যান করা হয় তাহলে বাস্তবে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়।
প্রতিদিন আজ্ঞাচক্রের মধ্যে মনসংযোগ করে 'ওঁ'কার নাম জপ করে যোগভ্যাস করা দরকার।
°°°°°° সহস্রার পদ্ম : এখানে 'কুণ্ডলিনী শক্তি' এলে সাধক সমাধিস্থ হয়। সহস্রারে সচ্চিদানন্দ শিব আছেন — তিনি শক্তির সহিত মিলিত হন। শিব-শক্তির বা ব্রহ্ম শক্তির মহামিলনস্থল এঁটি! সহস্রারে মন এসে সমাধিস্থ হয়ে আর বাহ্য থাকে না। মুখে দুধ দিলে গড়িয়ে যায়। এ অবস্থায় থাকলে একুশদিনে মৃত্যু হয় এবং সাধক পরব্রহ্মে লীন হয়।



পতঞ্জলী ঋষী যোগসূত্র
রাজযোগ - স্বামী বিবেকানন্দ
প্রাণায়াম রহস্য - স্বামী রামদেব
পরমার্থ প্রসঙ্গ - স্বামী বিরজানন্দ
মন ও তার নিয়ন্ত্রণ - স্বামী বুধানন্দ
ধ্যান ও মনের শক্তি - স্বামী বিবেকানন্দ



আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নূতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নূতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।
ভারতের সাধক ও সাধিকা
     পুণঃপ্ররচারে বিনীত
             প্রণয় সেন
                প্রণয়


Share on Google Plus

About Indian Monk - Pronay Sen

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.

0 comments :

Post a Comment