বাউল বাণী

স্বরূপানন্দ --- তুমি সেই একবার একটা ব্যাখ্যা বলেছিলে যে "গীতায় বলছে, জ্ঞানীগণ অভিমান শূন্য হয়ে কর্ম করেন। তুমি বললে জ্ঞানী মানেই তো অভিমান থাকবে না, তার আবার শূন্য হওয়া কি? এটা স্ববিরোধিতা। তোমার সেই কথাটা আমার খুব মনে আছে। 


গুরুজী ---- হ্যাঁ, দেখেছ, বলেছে ধর্মে যখন গ্লানি আসে - ধর্মে কখনো গ্লানি আসে না। ধর্মমতে আসে। ধর্ম যা সবকিছুকে ধারণ করে থাকে। 
কি এমন গ্লানি আছে, যে ধর্মের গ্লানি আনবে? আগুন সবকিছুকে পোড়াচ্ছে। কি এমন কাঠ-খড় আছে যা আগুনকে পোড়াবে? গীতায় এরকম স্ববিরোধী উক্তি আছে। আমি জানি। সেগুলো প্রক্ষিপ্ত। আমি এসবের contradictory -র মধ্যে বিশেষ যাই না। কারণ অতীতের পাঁক ঘাঁটা আমার স্বভাব নয়। আমি বর্তমানকে নিয়ে থাকি। অতীতের যদি কোনো ভালো দিক থাকে, জীবনধর্মী, তাহলে তাকে তুলে ধরি, নচেৎ নয়। আমার অন্য অনেক কাজ আছে। এসব দিক দিয়ে আমি খুব বিদ্রোহী। বিদ্রোহী মানে বিদ্রোহ করি না, এটা বিপ্লব বলতে পারো। আধ্যাত্মিক বিপ্লব। আমি কারুর দাসত্ব করি না। গীতা এই বলেছে, ভগবান এই বলেছে --- সুতরাং মানতে হবে ---- এসব আমার নেই। আমি শাস্ত্রের দাসত্ব করি না, হরিবংশ পুরাণ এই বলেছে, এটাই ঠিক -- তা বলি না। শাস্ত্র যদি জীবনবিরোধী কথা বলে, সে শাস্ত্র আমি মানি না। 
গীতায় বলেছে 'মা ফলেষু কদাচন' --- এটা কি কখনো সম্ভব যে ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে কর্ম করা? তোমরা কেউ পারো? আমি তোমাদের এক এক করে জিজ্ঞাসা করছি, পারো? 
ফল কামনা না করে কর্ম করতে? অন্তত আমি পারি না। আমার কামনা আছেই। আমি আমার গুরুজী রামানন্দ অবধূতকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বললাম গুরুজী, গীতায় বলেছে, 'মা ফলেষু কদাচন' --- এটা আমি কখনো মানতে পারবো না। কারণ, আপনার কাছে এসেছি, এখানেও আমার উদ্দেশ্য আছে। আপনাকে দর্শন করে, আপনার মুখের কথা শুনে পবিত্র হবো বলে। গুরুজী চিন্তা করে বললেন, ঠিক বলেছ। তবে তুমি এটা বুঝতে পেরেছ যে, তুমি আমার কাছে সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছ? আমি বললাম হ্যাঁ, সুতরাং মনে রাখবে, যা কিছু করছো তার উদ্দেশ্য যেন সৎ হয়। ঈশ্বর প্রীত্যর্থে
হয়। আমি তো ওনাকে মারতে বা Taunt করতে কিংবা দুটো খোঁচা মেরে কথা বলতে যেতেও পারতাম। যাক্ নিষ্কাম কর্ম মানে উদ্দেশ্যহীন কর্ম নয়। এটা আমার বইতেও লিখেছি। কর্মের একটা উদ্দেশ্য থাকবেই। আর তা না হলে তো ক্ষ্যাপার মত ঘুরবো। এই আমি পায়খানায় যাচ্ছি, তার একটা উদ্দেশ্য রয়েছে, শরীরকে আরাম দেওয়ার জন্য। প্রস্রাবে যাচ্ছিও সেই কারণে। তাহলে বলো কোন্ কাজটা উদ্দেশ্যবিহীন? আমার সব কাজেই উদ্দেশ্য আছে। লক্ষ্য আছে। এই যে অরফ্যান সেন্টার করেছি, আমার উদ্দেশ্য নেই বলছিস্? রাস্তায় রাস্তায় ছেলেগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তাদের তুলে এনে রেখেছি। যাতে ছেলেগুলো মানুষ হয়। এই যে চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি-এর উদ্দেশ্য নেই বলছিস্? উদ্দেশ্য আছে। নিষ্কাম কর্ম হয় না। তবে দেখতে হবে উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যেন সৎ হয়। আর যেরকম কর্ম হবে সেরকম ফল প্রদান করবে। 
অনেক সাধু-সন্ত আছে জানিস তো --- তারা নিষ্কাম কর্ম বলতে কর্ম ত্যাগ বোঝায়। অলসতা আর কি! বলবে সাধ হয়েছি, কর্ম করবো কি? সাধু-শাস্ত্রচর্চা করবে আর ভগবানের নাম-জপ করবে। আমার সাথে এই নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে, জানিস তো। আমি বললাম, তুমি যে পায়খানা-প্রস্রাব করছো এগুলো কর্ম নয়? 
পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মন, বুদ্ধি, চিত্ত ইত্যাদির সাহায্যে যে ক্রিয়া উৎপন্ন করছো, তাই তো কর্ম। আর পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় হচ্ছে বাক্, পাণি, পাদ, উপস্ত, পায়ু। সুতরাং এখানে তোমার জননেন্দ্রিয়, গুহ্যেন্দ্রিয় কাজ করছে না? খাচ্ছো তো? খাওয়া কি কর্ম নয়? নিঃশ্বাস নেওয়াটা কি কর্ম নয়? তাহলে কর্ম নয় কোনটা? কর্ম না করে কেউ থাকতে পারে? সুতরাং এসব কর্ম করবি আর অন্য সৎ কর্ম করবি না? আর যত কর্ম শুধুই কি এই সৎকর্মগুলো? তখন আমি ব্রহ্ম। হ্যাঁ, ১০ মিনিট খেতে দেরি হলে দেখবে, ব্রক্ষ্মত্ব কোথায় থাকে? তখন চেঁচাতে লাগবে। ব্রহ্ম কি খায়? খায় না। ব্রহ্ম কি কর্ম করে? করে না। তাহলে তুইও করিস না। নিঃশ্বাস নিস না। পায়খানা-প্রস্রাব করিস না। 

স্বরূপানন্দ - তাহলে তো মরে যাবে, নাহলে তাকে নির্বিকল্প সমাধিতে চলে যেতে হবে। ( সকলে হাসলো )।
গুরুজী ---- হ্যাঁ, এইসব। এইরকম যারা বলে তারা কুঁড়ে জানতে হবে‌। তাছাড়া কি? আমাদের ও আছে এইরকম। সন্ন্যাসী মানুষ কাজ করবে কি? এই চিন্তা, আমি কত করে বুঝিয়েছি। মানসিকতা আসলে তমোগুণ বুঝলি? তমো-গুণীরা কাজকে ভয় পায়। তমোগুণের লক্ষণ হচ্ছে আলস্য, জাড্য বা জড়তা। আর রজোগুণের লক্ষণ হচ্ছে ---- প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিযোগিতা, ভোগ, ঐশ্বর্য। আর সত্ত্বগুণ হচ্ছে জ্ঞান, বৈরাগ্য, বিবেক আর শ্রদ্ধা।
গুরুজী - নাস্তিকরাও ভগবান মানে না। কমিউনিষ্টরাও ভগবান ভগবান মানে না। বৌদ্ধরাও ভগবান মানে না। কিন্তু বুদ্ধকে মানে‌। ঈশ্বরের নামে নিন্দা কর, দেখবি, কি খুশি! 
কিন্তু বুদ্ধের নামে কিছু একটা নিন্দা কর, দেখবি কি অবস্থা করে! 

একজন --- বুদ্ধ নাস্তিক ছিলেন? 
গুরুজী --- বুদ্ধ নাস্তিকও নয়, আস্তিকও নয়। সমাধিস্থ অবস্থা। চিত্ত যেখানে শান্ত, স্থির ---যেখানে চিত্তে কোন wave নেই, চিত্তবৃত্তি একেবারে নিরোধ হয়ে যায়, একেবারে সমাধিস্থ অবস্থা, যেখানে একটা নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি বিরাজমান ----সেই অবস্থা থেকে বুদ্ধ কি বলতে পারেন! সেই অবস্থা থেকে কোন কিছু বলা সম্ভব? বুদ্ধ সেই অবস্থায় নীরব ছিলেন। এই অবস্থাটাকেই বুদ্ধত্ব বলছে‌। এই অবস্থাতেই শান্তি। তাই বুদ্ধ বললেন -----তোমরা বুদ্ধত্বপ্রাপ্ত হও। একে নির্বাণ বলছেন। 
যেহেতু ঈশ্বর সম্বন্ধে কিছু বলেননি, তাই বৌদ্ধরা বললো বুদ্ধ নাস্তিক ছিলেন। যেই নিয়ে দ্বন্দ্ব। ক্রমে নানা মত গড়ে উঠলো। এখন যেমন রামকৃষ্ণ নিয়ে নানা মত গড়ে উঠেছে জানতো! অরবিন্দ নিয়েও নিয়েও নানা মত গড়ে উঠেছে। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে যে সব নতুন সঙ্কলন বেরোচ্ছে, সেগুলোতে দেখবে ঠাকুরের অনেক কথাই বাদ দিয়ে বলছে। যেমন যদি ঠাকুরের "ওসব মতুয়ার বুদ্ধি" কথাটা লেখে, তাহলে কি মত থাকবে? থাকবে না। এসব দেখবে বাদ দেবে। 

একজন --- আচ্ছা গুরুজী, বুদ্ধের এই একক চিন্তাকে কি সার্বজনীন করা যায় না?
গুরুজী ---- কি করে করা যাবে? একক হচ্ছে সৃষ্টির বিরুদ্ধ। Unity অর্থাৎ সবই ব্রহ্ম ---- এই অবস্থা হলে সৃষ্টি থাকবে? Diversity, Variety হচ্ছে সৃষ্টির মূল তত্ত্ব। এটা তুমি প্রত্যেকটা সৃষ্টির ক্ষেত্রে পাবে। ঋষিরা সৃষ্টির এই মূল তত্ত্বটি অনুভব করলেন। এঁরা দেখলেন ----- সৃষ্টির সবকিছুতে একটা বৈচিত্র্য আছে কিন্তু সেখানে বিরোধ নেই। মানা না মানা নিয়ে তো যত দ্বন্দ্ব।
এ দুয়ের ঊর্দ্ধে গেলে দ্বন্দ্ব কোথায়? ঋষিরা সত্যকে দর্শন করলেন। বললেন, সর্বত্রই সেই
ব্রহ্ম রয়েছে। সুতরাং সৃষ্টির প্রত্যেকটিতে বৈচিত্র্য আছে কিন্তু বিরোধ নেই।

শুক্রবার মহালায়া বিকেলে বনোগ্রাম আশ্রমে -- নারান প্রণাম করার পর গুরুজী হেসে বললেন,--- এরা তিনজনই ---- Skinny, মাংস নেই।

একজন ----- আমার এত মাংস আছে যে হার খুঁজে পাওয়া যায় না। 
গুরুজী --- তাহলে তোর শরীর কোমল নাকি? কোমলতা যোগীর লক্ষণ। 

ঐ--- আমি প্র্যাকটিক্যাল বলছি, আমার শরীর সত্যিই নরম। তারজন্য আমার আসন করতে কোন অসুবিধা হয় না।
গুরুজী ---- আমি সত্যিই বলছি, এটা যোগীর লক্ষণ। যোগীদের শরীর নরম হয়। হাড় বেরোনো হয় না। স্বামীজী.... এঁদের দেখবে শরীর কেমন?

একজন --- কিন্তু অনেক সাধুর দেখেছি রোগা শরীর।
গুরুজী ---- শরীর দেখে আধ্যাত্মিক লক্ষণ বোঝা যায়। যারা সংসারী দেখবি তাদের শরীরে এই Joint- গুলো শক্ত হয়। সহজে Move করা যায় না। তার মানে বন্ধন রয়েছে। ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব তো এটাই দেখতেন, হাত নেড়েচেড়ে। 
হাতের কব্জি যদি এধার ওধার ঘোরানো যায় ইচ্ছামত --- সেই হাত ভালো। বন্ধনমুক্ত।  
আর আধ্যাত্মিকতার একটা লক্ষণ হচ্ছে চামড়া রেশমের মতো হবে। খসখসে হবে না। 
আমি ভালোমন্দ বিচার করি না। আমার সেই ধরণের কোন সংস্কার নেই যার দ্বারা আমি ভালোমন্দ বিচার করতে পারি। ভালোমন্দ বিচার করে মানুষ একটা সংস্কারের বশবর্তী হয়ে। আমার সেই ধরণের কোন সংস্কারের মাপকাঠি নেই। আমি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখি। ভালোমন্দ দেখি না। মানুষকে তিনটি গুণ দিয়ে দেখি ----  সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ। ত্রিগুণ প্রপঞ্চ। ভালোমন্দ নয়তো। এটা বৈচিত্র্য, Diversity.
মানুষের সংজ্ঞা কি? মানুষ কাকে বলে? 
কোন্ কোন্ বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে মানুষ বলা যায়? মানুষের প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মনুষ্যত্ব।
যার মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়েছে, তাকে মানুষ বলা যায়। এছাড়া মানবশরীর রয়েছে, মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়নি, তাকে নর-নারী বলে। পশুমানবও আমি বলি না। কারণ পশুদের অপমান করা হবে। পশুরা তাদের স্বভাবে রয়েছে। চৈতন্যদেব এধরণের মানুষকে বলতেন --- নরাধম। আর উন্নতমনের মানুষকে বলতেন নরোত্তম। মনুষ্যত্ব, মুমুক্ষুত্ব আর মহাপুরুষ সংশ্রয়। সুতরাং প্রথমে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হতে হবে। মনুষ্যত্ব কি? বিবেক আর শ্রদ্ধা। যার মধ্যে বিবেকজ্ঞান হয়েছে আর শ্রদ্ধা এসেছে, জানতে হবে তার মনুষ্যত্বের বিকাশ হয়েছে। বিবেক কি? না নিত্য অনিত্য বিচারবোধ। মনুষ্যত্বের পর আসছে দেবত্ব। দেবমানব কাকে বলে? না যিনি নিরভিমান আর নিঃস্বার্থ। সম্পূর্ণরূপে অভিমানশূন্য এবং ব্যক্তি-স্বার্থশূন্য। দেবত্বের উপর হচ্ছে ঈশ্বরত্ব। অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে অহঙ্কারশূন্য। অর্থাৎ শিব। অহঙ্কার যুক্ত হচ্ছে জড়ত্ব আর অহঙ্কারমুক্ত হচ্ছে শিবত্ব।
সুতরাং এটা ক্রমোন্নয়নের ধারা।

ভারতের সাধক ও সাধিকা
          বাউল বাণী
            শান্তি মা
      চরৈবেতি পত্রিকা
ভারতের সাধক ও সাধিকা



আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নুতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নুতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।

পুণঃপ্রচারে বিনীত 
     প্রণয় সেন
         প্রণয়
Share on Google Plus

About Indian Monk - Pronay Sen

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.

0 comments :

Post a Comment