সহজ মানুষের পূর্ণ ঠিকানা 'খোদাবক্স ফকির'
- প্রণয় সেন
লোকায়ত ভাবনার সমান্তরাল বৃত্তগুলি গভীর ভাবে সম্পৃক্ত হয় সহজাত অনুষঙ্গকে কেন্দ্রে রেখে। প্রতিষ্ঠিত হয় বার্তা—
‘নানান বরণ গাভী রে ভাই একই বরণ দুধ।
জগৎ ভরমিয়া দেখি একই মায়ের পুত।।’
এই বার্তাকে যিনি সম্যক ভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় আছেন তিনি হলেন মুর্শিদাবাদের সাধক বাউল ফকির 'খোদাবক্স ফকির'।
তিনি নিজেদের পরম্পরা বজায় রেখে আজকের দিনেও এই সাধনা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন,
আর শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ গড়ার সুমহান কাজ করে যাচ্ছেন। যে মানুষ হবে সোনার মানুষ;
যার দ্বারা কারো কোনরূপ ক্ষতি সাধন হবে না।
তাঁর ইচ্ছা তিনি রেখে যেতে চান তাঁর শিষ্যদের এই পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই মহান সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার গুরুদায়িত্ব আজ তাদের হাতে তিনি তুলে দিতে চান।
বাউল-ফকির-দরবেশি মতে, একই শরীরের আধারে তিন বার এই মনুষ্য জন্ম। এক বার শৈশবে, এক বার এই সহজিয়া মতে দীক্ষা-শিক্ষা লাভের দিন, শেষ বার এই মাটির শরীরের মৃত্যুর পর। মৃত্যু অমোঘ, চিরন্তন, ধ্রুব সত্য।
এই মৃত্যুর পর অন্য এক আলোর জীবন শুরু হয়।
তাই এই মাটির দেহের মৃত্যুর পর সহজ সাধকেরা কাঁদে না, গান গায়, আনন্দ করে।
আমি খুব আগ্ৰহের সাথে বাবাজীর সাথে দেখা করলাম। বললাম কিছু বলুন আপনার জীবন সম্পর্কে, খুবই বিনম্রতার সাথে বললেন, ক্ষ্যাপা, আগে শিশু হতে হবে তো।
তারপর সবই হবে। তিনি বলতে লাগলেন, আমার জন্ম মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার চোঁয়া গাঁয়ে। আমার বাবা গুরু আশ্রিত লোক ছিলেন। আমার বাবার দাদা এক ফকির ছিলেন। নাম তার তালেব ফকির। ওনার থেকে নানান ফকিরি আমরা দেখেছি, আমাদের বাড়িতে তখন অনেক বাংলাদেশী ফকির বাউলরা আসতেন ( অবিভক্ত বাংলা )। তাঁদেরকে দেখতাম গানবাজনা করতো, আসর বসতো, অনেক মানুষ সেবা নিত।
সবশেষে তাঁরা তাদের অন্তরঙ্গ নিজেদের কথা জনসমক্ষে বলতেন না, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন। মনের কথা, ভাবের কথা, রসের কথা, প্রেমের কথা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতেন। মনে আক্ষেপ হত খুব। ভাবতাম, এ কথা তো আমি জানতে পারছি না, যতদিন না গুরু আশ্রিত হচ্ছি। আমার এক চাঁচা তিনিও ফকির ছিলেন, গান গাইতেন। তার সাথে সাত বছর থাকলাম তবুও কিছু জানতে পারলাম না। শেষে গুরুর দেখা মিলে গেলো, গুরু আশ্রিত হলাম। তাঁর নাম সিরাজ ফকির। তিনিও দুবছর পর দেহ রাখলেন কামাখ্যায়। আমার যিনি গুরু মা ছিলেন তিনি অনেক বড়ো সাধিকা ছিলেন, তাঁর সঙ্গ পেয়ে তারপর কিছু জানতে পারলাম। তারপর আরও কিছু জানলাম সাধু গুরু বৈষ্ণবদের সঙ্গ করে।
আর নিজের আত্মতত্ত্ব বিচার করে।
মহাজনের পদ পড়ে দেখলাম তার মধ্যে অনেক কিছুই আছে। ভবা পাগলার গানের মধ্যে এক জায়গায় দেখলাম লেখা আছে ---
"নিজ পায়ে দাড়াতে শিখ, মনকে বুঝাও।"
লালন সাঁইজির গানের মধ্যে পেলাম -----
"তোমার ভুল, তুমি সার। তুমি তোমাকে দেখো,
আর তোমার ভুলগুলো শুধরে নেও।"
পরে এসে আরও জানতে পারলাম, বুঝতে শিখলাম যে কথা গুলো হচ্ছে, যে কথাগুলো শুনছি এসবও ঠিক না। এরপর আরও আছে।
"নিহেতু বিশ্বাসে মিলে সেই মানুষ।"
হেতুকর্মের মধ্যে সেই মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রকৃতির সাথে রমণ করে বেঁচে গেল, তার কিছু হয়ে গেলো, ব্যাপারটা তেমন না।
লালন সাঁইজি বলছেন,
"হেতু করণে ফকির লালন যায় মারা।"
মানে তোমাকে শিশুর মতো হতে হবে, এটাই হলো করণ। সেই ভাব যখন তুমি ধারণ করতে পারবে তখন প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে।
মনকে জানতে হবে, মনকে বোঝাতে হবে,
শান্ত করতে হবে। যে মানুষের মধ্যে সহ্য নাই, ধৈর্য্য নাই, ক্ষমা নাই, দয়া নাই তার কিছুই হবে না। এইভাব রেখে আমি আমার জীবনধারা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার প্রচুর লড়াই চলে, জ্ঞানেন্দ্রীয়, কর্মেন্দ্রীয় এদের সাথে বা আমার মন আছে, জ্ঞান আছে, বিবেক আছে, বুদ্ধি আছে এদেরকে খাটিয়ে সংগ্রামে আমি ব্যাস্ত। যাতে করে নিজেকে আমি সেই পথে পরিচালিত করতে পারি। এটাই আমার ঊর্ধ্ব গতি। এই পথে কতদূর যেতে পারবো আমি জানিনে, আমি সেই পথের সেই সংগ্রামে রত।
মানে এক নম্বরে যেতে হবে।
বাঁচতে গেলে সুস্থভাবে লড়াই করে বাঁচতে হবে প্রকৃতির সাথে। প্রকৃতি আমাদের চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, একটা প্রকৃতি না। প্রকৃতি বিচার করতে গেলে অনেক রকম প্রকৃতি ভেসে ভেসে আসে, মনের মধ্যে ভেসে ওঠে, তো, জ্ঞানঅস্ত্র দিয়ে সেটাকে কাটতে হবে। জ্ঞানঅস্ত্র টাকে রোজ ধার দিতে হবে, ভোঁতা হলে কাটবে না। এই পথেই আমি হাঁটছি। জানিনা কতদূর পৌঁছাতে পারবো।
এগুলোই মানুষের জীবনে খুবই দরকার।
মানুষ রিপু ইন্দ্রিয় এগুলো নিয়েই বেঁচে আছে।
এটাকে বাঁচা বলে না। যারা নাম রসে ডুবতে পারে, নামেরও একটা রস আছে।
মানে কেউ হরিনাম করে, কেউ গুরু নাম করে, কেউ আল্লার নাম করে। তো সেই নামের সুধার মধ্যে ডুবতে হবে। সেই সুধা আস্বাদন করতে হবে।
আমার বাবা চাষী গৃহস্ত মানুষ ছিলেন, জমি ছিল। সেখানে চাষাবাদ করতেন। আমরা কোনোদিন বাজারের জিনিস কিনে খাই না।
আমি ছোট থেকেই গান করতাম, আমার সঙ্গীরা আমাকে বাবা মায়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেত নানান আসরে, সাধু ফকিরের আস্তানায়।
বলতো এঁকে ছাড়তে হবে। বাবা মাও আপনাকে খুব সাহায্য করছেন, তাই আজ আমি এই জায়গায় আসতে পেরেছি, না হলে আসতে পারতাম না। আমার এই পথে আসার জন্যে আমার বাবা আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করতেন।
তাঁর কৃপায় আমি শুধু সাধু সঙ্গ করে বেড়িয়েছি।
আমরা বলি আউল, বাউল, সাঁই দরবেশ।
আউল মানে প্রথম।
বাউল ফকির সাধকদের সাধনার চারটি স্তর আছে স্থুল, প্রবর্ত, সাধক ও সিদ্ধ। সিদ্ধতে কোনো কর্ম হবে না, যদি এই প্রবর্ত না সাধে। প্রবর্তের দশা কি তাকে শক্ত করে ঘরের দরজা দিতে হবে। 'প্রবর্ত-অবস্থায় প্রাথমিক কতকগুলি নিয়ম-পালন,—“নামাপ্রয়’, ‘মন্ত্রাশ্রয় প্রভৃতি গ্রহণ ; তারপর সাধক"-অবস্থা হইতে ‘ভাবাপ্ৰয়’ গ্রহণ করিতে হয়। ‘ভাব'-এ প্রবেশ গুরুর পরীক্ষা ও উপদেশ-সাপেক্ষ । ভাবে প্রবেশ করিলে, প্রকৃতি-সাধন আরম্ভ হয়,—তখন রসাশ্রয়’ ‘প্রেমাঞ্জয়’ প্রভৃতি গ্রহণ। ভাবে প্রবেশ করিলে! শান্ত দাস্য ভাব এমনি হবে না। তাকে নিজের মধ্যে রূপান্তরিত করতে হবে। শান্ত দাস্য ভাব কাকে বলে তা জানতে হবে। তার কী কী গুণ আছে তা জানতে হবে। শান্ত ভাবের চারটি গুণ, দাস্য ভাবের চারটি গুণ, সাধকের চারটি গুণ, কামের চারটি গুণ আছে। এগুলি যদি ব্যাখ্যা করে নিজের মধ্যে আত্মস্ত করা যায় তবেই হবে। ধরো শান্ত ভাবের চারটি গুণ হলো, সহ্য, ধৈর্য্য, ক্ষমা, দয়া। এই চারটি আগে আঁকড়ে ধরে শান্ত হও। এই চারটি আসছে কিনা আগে দেখো, তারপর শান্ত হলেই দাস্য ভাব আসবে।
আবার এই দাস্য ভাবের চারটি গুণ আছে।
এই ভাবে এগোতে হয় বাবা, এক একটি স্তর ভেদ করে তোমায় যেতে হবে। তবেই মিলবে তাঁর দেখা।
শাহ আবদুল করিম একটি গান তিনি গাইলেন,
গান গাই আমার মনরে বুঝাই
মন থাকে পাগলপারা
আর কিছু চায়না মনে গান ছাড়া ।।
গানে বন্ধুরে ডাকি গানে প্রেমের ছবি আঁকি
পাব বলে আশা রাখি না পাইলে যাব মারা
আর কিছু চায়না মনে গান ছাড়া ।।
গান আমার জপমালা গানে খুলে প্রেমের তালা
প্রাণ বন্ধু চিকন কালা অন্তরে দেয় ইশারা
আর কিছু চায়না মনে গান ছাড়া ।।
ভাবে করিম দ্বীনহীন আসবে কি আর শুভদিন
জল ছাড়া কি বাঁচিবে মীন ডুবলে কি ভাসে মরা
আর কিছু চায়না মনে গান ছাড়া ।।
আমি গান গাই আর মনকে বোঝাই এই আমার ভাব, কেউ গুরু নাম করে কেউ হরিনাম করে। মনকে বোঝাতে হবে এই ঐ খানে ডুবে থাক, ওই ভাবে মজে থাক, তাহলেই হবে।
আমাদের কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো,
বাবাজী বললেন, এবার আমাকে নামাজে যেতে হবে বাবা। আজ এটুকুই থাক। আমি বললাম বাবা আপনার নামাজ কী আলাদা? তিনি বললেন, দুদ্দু শাহ্ ফকির বলেছেন,
"রূপ দেখে বন্দিগী আদায়, ফরমিয়েছে
আপে খোদায়।
অহুয়া মায়াকুম দলিলে কয়, নজির দেখা যায়।
না দেখে রূপ সেজদা করে, অন্ধ তারে কয়।
মুরশিদকে চিনিয়া যে জন, করেছে সে রূপ অন্বেষণ
দরবেশ সাঁইয়ের বচন, দুদ্দুর ভুল সদায়।"
যারা রূপ দেখে সেজদা করে তারা এক ধারা, আর যারা না দেখে করে তারা আরেক ধারা। যারা রূপ না দেখে সেজদা করে অন্ধ প্রায়। চোখ থাকতে তো রূপ দেখে নাই। ফকিরের ধারায় আছে রূপ দেখে সেজদা করার কথা। ফকিররা এ ধারায় নামাজ পড়ে। বাউলের, বৈষ্ণবের এরাও ত্রিসন্ধ্যা করে।
হাউড়ে গোঁসাই বললেন,
"সগগ্ৰামকে স্থানান্তরে গুরু যদি বসত করে, ত্রিসন্ধ্যা গুরু করণে থাকিবে ভক্ত।"
গুরু যদি দেশ বা দেশের বাইরে থাকে তাও ভক্তকে ত্রিসন্ধ্যা করতে হবে।
এটাও একটা নামাজের ধারা।
শেষ করি 'গোলাম মোস্তফা'র কবিতা দিয়ে,
অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি
বিচার দিনের স্বামী।
যত গুণগান হে চির মহান
তোমারি অন্তর্যামী।
দ্যুলোক-ভূলোক সবারে ছাড়িয়া
তোমারি চরণে পড়ি লুটাইয়া
তোমারি সকাশে যাচি হে শকতি
তোমারি করুণাকামী।
সরল সঠিক পূণ্য পন্থা
মোদের দাও গো বলি,
চালাও সে-পথে যে-পথে তোমার
প্রিয়জন গেছে চলি।
যে-পথে তোমার চির-অভিশাপ
যে-পথে ভ্রান্তি, চির-পরিতাপ
হে মহাচালক,মোদের কখনও
করো না সে পথগামী।
আমি প্রণয়, অনেক সাধুসঙ্গ করেছি ও আপনাদের আশির্বাদে আরও অনেক মহৎ সাধুসঙ্গ হবে, কিন্তু খোদাবক্স ফকির বাবাকে দেখে আমার মনে সত্যি খুব আশা জাগলো কিছু লিখি। উক্ত এই উপলব্ধি লব্ধ লেখাটি আমার নিজের কাঁচা হাতের লেখা। ভুল ত্রুটি হলে মার্জনা করবেন।
আজ এই জনসমক্ষে বাবাজীর এই আত্মপ্রকাশের মূল কান্ডারী হলেন শ্রদ্ধেয় রক্তিম বরণ চক্রবর্তী মহাশয়। তিনি আমাকে জানালেন, বাবাজী খুব গুপ্তভাবে তাঁর সাধন চর্চায় নিমগ্ন ছিলেন,
তার ঐকান্তিক ইচ্ছায় আজকে আমরা এই মহান সাধক শিল্পীর সান্নিধ্য পাচ্ছি এবং পাবো।
রক্তিম বাবুকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং 'খোদাবক্স ফকির'কে ভক্তি দিয়ে লেখা এইখানে শেষ করলাম। জয় গুরু।
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নুতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নুতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।
পুণঃপ্রচারে বিনীত -
🕉️ প্রণয় সেন ☪️
- প্রণয় সেন
লোকায়ত ভাবনার সমান্তরাল বৃত্তগুলি গভীর ভাবে সম্পৃক্ত হয় সহজাত অনুষঙ্গকে কেন্দ্রে রেখে। প্রতিষ্ঠিত হয় বার্তা—
‘নানান বরণ গাভী রে ভাই একই বরণ দুধ।
জগৎ ভরমিয়া দেখি একই মায়ের পুত।।’
এই বার্তাকে যিনি সম্যক ভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় আছেন তিনি হলেন মুর্শিদাবাদের সাধক বাউল ফকির 'খোদাবক্স ফকির'।
তিনি নিজেদের পরম্পরা বজায় রেখে আজকের দিনেও এই সাধনা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন,
আর শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ গড়ার সুমহান কাজ করে যাচ্ছেন। যে মানুষ হবে সোনার মানুষ;
যার দ্বারা কারো কোনরূপ ক্ষতি সাধন হবে না।
তাঁর ইচ্ছা তিনি রেখে যেতে চান তাঁর শিষ্যদের এই পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই মহান সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার গুরুদায়িত্ব আজ তাদের হাতে তিনি তুলে দিতে চান।
বাউল-ফকির-দরবেশি মতে, একই শরীরের আধারে তিন বার এই মনুষ্য জন্ম। এক বার শৈশবে, এক বার এই সহজিয়া মতে দীক্ষা-শিক্ষা লাভের দিন, শেষ বার এই মাটির শরীরের মৃত্যুর পর। মৃত্যু অমোঘ, চিরন্তন, ধ্রুব সত্য।
এই মৃত্যুর পর অন্য এক আলোর জীবন শুরু হয়।
তাই এই মাটির দেহের মৃত্যুর পর সহজ সাধকেরা কাঁদে না, গান গায়, আনন্দ করে।
আমি খুব আগ্ৰহের সাথে বাবাজীর সাথে দেখা করলাম। বললাম কিছু বলুন আপনার জীবন সম্পর্কে, খুবই বিনম্রতার সাথে বললেন, ক্ষ্যাপা, আগে শিশু হতে হবে তো।
তারপর সবই হবে। তিনি বলতে লাগলেন, আমার জন্ম মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার চোঁয়া গাঁয়ে। আমার বাবা গুরু আশ্রিত লোক ছিলেন। আমার বাবার দাদা এক ফকির ছিলেন। নাম তার তালেব ফকির। ওনার থেকে নানান ফকিরি আমরা দেখেছি, আমাদের বাড়িতে তখন অনেক বাংলাদেশী ফকির বাউলরা আসতেন ( অবিভক্ত বাংলা )। তাঁদেরকে দেখতাম গানবাজনা করতো, আসর বসতো, অনেক মানুষ সেবা নিত।
সবশেষে তাঁরা তাদের অন্তরঙ্গ নিজেদের কথা জনসমক্ষে বলতেন না, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন। মনের কথা, ভাবের কথা, রসের কথা, প্রেমের কথা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতেন। মনে আক্ষেপ হত খুব। ভাবতাম, এ কথা তো আমি জানতে পারছি না, যতদিন না গুরু আশ্রিত হচ্ছি। আমার এক চাঁচা তিনিও ফকির ছিলেন, গান গাইতেন। তার সাথে সাত বছর থাকলাম তবুও কিছু জানতে পারলাম না। শেষে গুরুর দেখা মিলে গেলো, গুরু আশ্রিত হলাম। তাঁর নাম সিরাজ ফকির। তিনিও দুবছর পর দেহ রাখলেন কামাখ্যায়। আমার যিনি গুরু মা ছিলেন তিনি অনেক বড়ো সাধিকা ছিলেন, তাঁর সঙ্গ পেয়ে তারপর কিছু জানতে পারলাম। তারপর আরও কিছু জানলাম সাধু গুরু বৈষ্ণবদের সঙ্গ করে।
আর নিজের আত্মতত্ত্ব বিচার করে।
মহাজনের পদ পড়ে দেখলাম তার মধ্যে অনেক কিছুই আছে। ভবা পাগলার গানের মধ্যে এক জায়গায় দেখলাম লেখা আছে ---
"নিজ পায়ে দাড়াতে শিখ, মনকে বুঝাও।"
লালন সাঁইজির গানের মধ্যে পেলাম -----
"তোমার ভুল, তুমি সার। তুমি তোমাকে দেখো,
আর তোমার ভুলগুলো শুধরে নেও।"
পরে এসে আরও জানতে পারলাম, বুঝতে শিখলাম যে কথা গুলো হচ্ছে, যে কথাগুলো শুনছি এসবও ঠিক না। এরপর আরও আছে।
"নিহেতু বিশ্বাসে মিলে সেই মানুষ।"
হেতুকর্মের মধ্যে সেই মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রকৃতির সাথে রমণ করে বেঁচে গেল, তার কিছু হয়ে গেলো, ব্যাপারটা তেমন না।
লালন সাঁইজি বলছেন,
"হেতু করণে ফকির লালন যায় মারা।"
মানে তোমাকে শিশুর মতো হতে হবে, এটাই হলো করণ। সেই ভাব যখন তুমি ধারণ করতে পারবে তখন প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে।
মনকে জানতে হবে, মনকে বোঝাতে হবে,
শান্ত করতে হবে। যে মানুষের মধ্যে সহ্য নাই, ধৈর্য্য নাই, ক্ষমা নাই, দয়া নাই তার কিছুই হবে না। এইভাব রেখে আমি আমার জীবনধারা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার প্রচুর লড়াই চলে, জ্ঞানেন্দ্রীয়, কর্মেন্দ্রীয় এদের সাথে বা আমার মন আছে, জ্ঞান আছে, বিবেক আছে, বুদ্ধি আছে এদেরকে খাটিয়ে সংগ্রামে আমি ব্যাস্ত। যাতে করে নিজেকে আমি সেই পথে পরিচালিত করতে পারি। এটাই আমার ঊর্ধ্ব গতি। এই পথে কতদূর যেতে পারবো আমি জানিনে, আমি সেই পথের সেই সংগ্রামে রত।
মানে এক নম্বরে যেতে হবে।
বাঁচতে গেলে সুস্থভাবে লড়াই করে বাঁচতে হবে প্রকৃতির সাথে। প্রকৃতি আমাদের চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, একটা প্রকৃতি না। প্রকৃতি বিচার করতে গেলে অনেক রকম প্রকৃতি ভেসে ভেসে আসে, মনের মধ্যে ভেসে ওঠে, তো, জ্ঞানঅস্ত্র দিয়ে সেটাকে কাটতে হবে। জ্ঞানঅস্ত্র টাকে রোজ ধার দিতে হবে, ভোঁতা হলে কাটবে না। এই পথেই আমি হাঁটছি। জানিনা কতদূর পৌঁছাতে পারবো।
এগুলোই মানুষের জীবনে খুবই দরকার।
মানুষ রিপু ইন্দ্রিয় এগুলো নিয়েই বেঁচে আছে।
এটাকে বাঁচা বলে না। যারা নাম রসে ডুবতে পারে, নামেরও একটা রস আছে।
মানে কেউ হরিনাম করে, কেউ গুরু নাম করে, কেউ আল্লার নাম করে। তো সেই নামের সুধার মধ্যে ডুবতে হবে। সেই সুধা আস্বাদন করতে হবে।
আমার বাবা চাষী গৃহস্ত মানুষ ছিলেন, জমি ছিল। সেখানে চাষাবাদ করতেন। আমরা কোনোদিন বাজারের জিনিস কিনে খাই না।
আমি ছোট থেকেই গান করতাম, আমার সঙ্গীরা আমাকে বাবা মায়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেত নানান আসরে, সাধু ফকিরের আস্তানায়।
বলতো এঁকে ছাড়তে হবে। বাবা মাও আপনাকে খুব সাহায্য করছেন, তাই আজ আমি এই জায়গায় আসতে পেরেছি, না হলে আসতে পারতাম না। আমার এই পথে আসার জন্যে আমার বাবা আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করতেন।
তাঁর কৃপায় আমি শুধু সাধু সঙ্গ করে বেড়িয়েছি।
আমরা বলি আউল, বাউল, সাঁই দরবেশ।
আউল মানে প্রথম।
বাউল ফকির সাধকদের সাধনার চারটি স্তর আছে স্থুল, প্রবর্ত, সাধক ও সিদ্ধ। সিদ্ধতে কোনো কর্ম হবে না, যদি এই প্রবর্ত না সাধে। প্রবর্তের দশা কি তাকে শক্ত করে ঘরের দরজা দিতে হবে। 'প্রবর্ত-অবস্থায় প্রাথমিক কতকগুলি নিয়ম-পালন,—“নামাপ্রয়’, ‘মন্ত্রাশ্রয় প্রভৃতি গ্রহণ ; তারপর সাধক"-অবস্থা হইতে ‘ভাবাপ্ৰয়’ গ্রহণ করিতে হয়। ‘ভাব'-এ প্রবেশ গুরুর পরীক্ষা ও উপদেশ-সাপেক্ষ । ভাবে প্রবেশ করিলে, প্রকৃতি-সাধন আরম্ভ হয়,—তখন রসাশ্রয়’ ‘প্রেমাঞ্জয়’ প্রভৃতি গ্রহণ। ভাবে প্রবেশ করিলে! শান্ত দাস্য ভাব এমনি হবে না। তাকে নিজের মধ্যে রূপান্তরিত করতে হবে। শান্ত দাস্য ভাব কাকে বলে তা জানতে হবে। তার কী কী গুণ আছে তা জানতে হবে। শান্ত ভাবের চারটি গুণ, দাস্য ভাবের চারটি গুণ, সাধকের চারটি গুণ, কামের চারটি গুণ আছে। এগুলি যদি ব্যাখ্যা করে নিজের মধ্যে আত্মস্ত করা যায় তবেই হবে। ধরো শান্ত ভাবের চারটি গুণ হলো, সহ্য, ধৈর্য্য, ক্ষমা, দয়া। এই চারটি আগে আঁকড়ে ধরে শান্ত হও। এই চারটি আসছে কিনা আগে দেখো, তারপর শান্ত হলেই দাস্য ভাব আসবে।
আবার এই দাস্য ভাবের চারটি গুণ আছে।
এই ভাবে এগোতে হয় বাবা, এক একটি স্তর ভেদ করে তোমায় যেতে হবে। তবেই মিলবে তাঁর দেখা।
শাহ আবদুল করিম একটি গান তিনি গাইলেন,
গান গাই আমার মনরে বুঝাই
মন থাকে পাগলপারা
আর কিছু চায়না মনে গান ছাড়া ।।
গানে বন্ধুরে ডাকি গানে প্রেমের ছবি আঁকি
পাব বলে আশা রাখি না পাইলে যাব মারা
আর কিছু চায়না মনে গান ছাড়া ।।
গান আমার জপমালা গানে খুলে প্রেমের তালা
প্রাণ বন্ধু চিকন কালা অন্তরে দেয় ইশারা
আর কিছু চায়না মনে গান ছাড়া ।।
ভাবে করিম দ্বীনহীন আসবে কি আর শুভদিন
জল ছাড়া কি বাঁচিবে মীন ডুবলে কি ভাসে মরা
আর কিছু চায়না মনে গান ছাড়া ।।
আমি গান গাই আর মনকে বোঝাই এই আমার ভাব, কেউ গুরু নাম করে কেউ হরিনাম করে। মনকে বোঝাতে হবে এই ঐ খানে ডুবে থাক, ওই ভাবে মজে থাক, তাহলেই হবে।
আমাদের কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো,
বাবাজী বললেন, এবার আমাকে নামাজে যেতে হবে বাবা। আজ এটুকুই থাক। আমি বললাম বাবা আপনার নামাজ কী আলাদা? তিনি বললেন, দুদ্দু শাহ্ ফকির বলেছেন,
"রূপ দেখে বন্দিগী আদায়, ফরমিয়েছে
আপে খোদায়।
অহুয়া মায়াকুম দলিলে কয়, নজির দেখা যায়।
না দেখে রূপ সেজদা করে, অন্ধ তারে কয়।
মুরশিদকে চিনিয়া যে জন, করেছে সে রূপ অন্বেষণ
দরবেশ সাঁইয়ের বচন, দুদ্দুর ভুল সদায়।"
যারা রূপ দেখে সেজদা করে তারা এক ধারা, আর যারা না দেখে করে তারা আরেক ধারা। যারা রূপ না দেখে সেজদা করে অন্ধ প্রায়। চোখ থাকতে তো রূপ দেখে নাই। ফকিরের ধারায় আছে রূপ দেখে সেজদা করার কথা। ফকিররা এ ধারায় নামাজ পড়ে। বাউলের, বৈষ্ণবের এরাও ত্রিসন্ধ্যা করে।
হাউড়ে গোঁসাই বললেন,
"সগগ্ৰামকে স্থানান্তরে গুরু যদি বসত করে, ত্রিসন্ধ্যা গুরু করণে থাকিবে ভক্ত।"
গুরু যদি দেশ বা দেশের বাইরে থাকে তাও ভক্তকে ত্রিসন্ধ্যা করতে হবে।
এটাও একটা নামাজের ধারা।
শেষ করি 'গোলাম মোস্তফা'র কবিতা দিয়ে,
অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি
বিচার দিনের স্বামী।
যত গুণগান হে চির মহান
তোমারি অন্তর্যামী।
দ্যুলোক-ভূলোক সবারে ছাড়িয়া
তোমারি চরণে পড়ি লুটাইয়া
তোমারি সকাশে যাচি হে শকতি
তোমারি করুণাকামী।
সরল সঠিক পূণ্য পন্থা
মোদের দাও গো বলি,
চালাও সে-পথে যে-পথে তোমার
প্রিয়জন গেছে চলি।
যে-পথে তোমার চির-অভিশাপ
যে-পথে ভ্রান্তি, চির-পরিতাপ
হে মহাচালক,মোদের কখনও
করো না সে পথগামী।
আমি প্রণয়, অনেক সাধুসঙ্গ করেছি ও আপনাদের আশির্বাদে আরও অনেক মহৎ সাধুসঙ্গ হবে, কিন্তু খোদাবক্স ফকির বাবাকে দেখে আমার মনে সত্যি খুব আশা জাগলো কিছু লিখি। উক্ত এই উপলব্ধি লব্ধ লেখাটি আমার নিজের কাঁচা হাতের লেখা। ভুল ত্রুটি হলে মার্জনা করবেন।
আজ এই জনসমক্ষে বাবাজীর এই আত্মপ্রকাশের মূল কান্ডারী হলেন শ্রদ্ধেয় রক্তিম বরণ চক্রবর্তী মহাশয়। তিনি আমাকে জানালেন, বাবাজী খুব গুপ্তভাবে তাঁর সাধন চর্চায় নিমগ্ন ছিলেন,
তার ঐকান্তিক ইচ্ছায় আজকে আমরা এই মহান সাধক শিল্পীর সান্নিধ্য পাচ্ছি এবং পাবো।
রক্তিম বাবুকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং 'খোদাবক্স ফকির'কে ভক্তি দিয়ে লেখা এইখানে শেষ করলাম। জয় গুরু।
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নুতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নুতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।
পুণঃপ্রচারে বিনীত -
🕉️ প্রণয় সেন ☪️
0 comments :
Post a Comment