সুখের চাবিকাঠি –
যখন কোথাও ভ্রমণে যাই তখন সঙ্গী থাকে অনেক ভ্রমণেই। যখন সাধুসন্ন্যাসী খুঁজে বেড়াই বা সাধুসঙ্গ করি তখন কোনও সঙ্গীকে নিই না সঙ্গে। কারণ ওদের ধৈর্য কম। তাড়া দিতে থাকে। কথা বলা যায় না। উদ্দেশ্যটাও নষ্ট হয় আমার, তাই সঙ্গী নিই না। এখন বেড়িয়েছি একা।
আজ থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। ফিরছি নাঙ্গাবাবার আশ্রম থেকে। আসার পথে পড়ে লোকনাথ মন্দির। এই মন্দিরে যাওয়ার পথের দুধারেই বিশাল বিশাল অশ্বত্থ আর তেঁতুল গাছ। অনেকটা জায়গা জুড়ে বেশ বাগানের পরিবেশ। মন্দিরের একটু আগেই একটা অশ্বত্থগাছের গোড়ায় দেখি জনাদশেক নারীপুরুষ বসে আছে বিভিন্ন বয়সের। সবাই বসে আছে এক সাধুবাবাকে ঘিরে। সাধুবাবাও বসে আছেন গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে। এসব লক্ষ্য করলাম দূর থেকেই। বুঝলাম ওখানে একটা কিছু ব্যাপার আছে। রিকশা ছেড়ে দিলাম ভাড়া মিটিয়ে।
কৌতূহল আমার আজ না, বরাবরই। তাই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। অনেকটা কাছাকাছি হলাম ওদের। উপস্থিত সকলে তাকালেন আমার মুখের দিকে। কেউ কোনও কথা বললেন না। তবে সকলেই যে একটু বিরক্ত হলেন মুখের ভাব দেখে তা বুঝলাম। আরও বুঝলাম, অনেকক্ষণ ধরে কথা হচ্ছে ওদের। আমার উপস্থিতিতে চুপ করে গেলেন সাধুবাবা।
সাধু আমি বহু দেখেছি, তবে এমন সাধু এই প্রথম। পরনের কাপড়টা একেবারে শতচ্ছিন্ন হাঁটু পর্যন্ত। নোংরা আর কাকে বলে! এত নোংরা, উদাহরণেও আনা যায় না। গালভর্তি কাঁচায় পাকায় দাড়ি। খোঁচাখোঁচা অথচ বড়। দাড়ি বড় অথচ খোঁচা খোঁচা এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। একমাথা ঝাঁকড়া চুল একেবারেই এলোমেলো। ঝোড়ো কাকের বাসা যেন। চুলগুলো ময়লাতে জটাজটা লাগছে। গায়ের রঙও ময়লা। একে ময়লা, তার উপরে দীর্ঘকাল স্নান করেনি, ফলে দশাটাও যেমন হয় তেমনই। গায়ে গলায় কিছুই নেই। একটা মালা পর্যন্ত নয়। কপালে তিলক টিলকও কিছু নেই। পাশে একটা ছোট্ট পোঁটলা। কাঁধে ঝোলানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। মনে হয় বগলদাবা করে নিয়েই পথ চলতে হয়। দেখলে পাগল কিংবা না খাওয়া ভিখারি ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। অন্তত অন্যে তাই ভাববে। সাধুবাবার ভাবে বুঝলাম, এসব কথা তাঁর ভাবার অবকাশ নেই। সাধু ভেবে শ্রদ্ধা তো দূরের কথা, কথা বলারও প্রবৃত্তি হবে না কারও। তবুও সকলের পাশ কাটিয়ে গিয়ে প্রণাম করলাম। দাঁড়ালাম সাধুবাবার বাঁপাশে।
একবার মুখের দিকে তাকালেন। বসতে বললেন ইশারায়। এই তাকানোতেই সর্বাঙ্গে একটা শিহরণ খেলে গেল আমার। চোখ আমি বহু সাধুরই দেখেছি, তবে এমন চোখ দেখলাম এই প্রথম। ভিতর থেকে যেন বিদ্যুতের আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। তাকানো যায় না চোখের দিকে। দেহের বিষয় যাইহোক, চোখদুটো দেখে বুঝলাম এ সাধুবাবা উচ্চমার্গের কোনও মহাত্মা হবেন।
বসলাম, সাধুবাবার ইশারাতেই বসলাম। মাটিতে আর সকলে যেমন বসে আছে। এখনও একটা কথাও শুনিনি। তাই বুঝতে পারছি না কোন ভাষাভাষীর লোক। আমার আসাতে এখানকার পরিস্থিতিটা একটু অন্য রকম হয়েছিল। সাধুবাবা বসতে বলায় আবার আগের অবস্থাটাই ফিরে এল ধীরে ধীরে। রাজা সরাসরি কাউকে গ্রহণ করলে পার্ষদদের কিছু বলার থাকে না, এখানেও ঠিক তাই হল।
একটা কথাও বললাম না। সাধুবাবাকে ঘিরে রয়েছে যারা তাদের চেহারা দেখে বুঝলাম, প্রত্যেকেই ওড়িশাবাসী। ছজন মহিলা, পুরুষ চারজন। এদের পোশাক দেখে মনে হল বেশ দরিদ্র। ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে এক মহিলা বললেন,
– বাবা, আমার কথাটার উত্তর দিলেন না?
একটু আনমনা হয়ে বললেন,
– কি যেন বলেছিলি?
এবার কথাতে বুঝতে পারলাম সাধুবাবা হিন্দিভাষী। ওই মহিলা বললেন,
– ওই যে বললাম প্রায় রাতেই স্বপ্ন দেখি। কখনও ভূতপ্রেত, কখনও ভয়ের আবার কখনও দেখি আজেবাজে স্বপ্ন যার মাথামুণ্ডু নেই। ভীষণ ভয় পাই। দয়া করে এমন একটা কিছু দিন যাতে ওসব বন্ধ হয়ে যায়।
একমুহুর্ত কি যেন চিন্তা করলেন সাধুবাবা। বসলেন সোজা হয়ে। কোনও কথা না বলে সকলকে দেখছি – দেখছি সাধুবাবাকেও। আমার উপস্থিতিতে প্রাথমিক অস্বস্তিটা কেটে গেছে ইতিমধ্যেই। তিনি বললেন,
– রবি আর বৃহস্পতিবার বাদ দিবি। সকাল থেকে বেলা বারোটার মধ্যে একটা তুলসী পাতা তুলবি বোঁটা সমেত। বাড়িতে গাছ না থাকলে কেনা তুলসীপাতা হলেও চলবে। এবার তুই যে বালিশে মাথা রেখে ঘুমাস, সেই বালিশের ওয়াড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দিবি। একদিনই রাখবি। ব্যস, ধীরে ধীরে দেখবি কুস্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে যাবে। খেয়াল করবি, পাতাটা যেন ভিতর থেকে বেরিয়ে না পড়ে যায়। প্রতিদিন বিছানায় শুধু গঙ্গার জল ছিটিয়ে ঘুমলেও ওই একই ফল হবে। এখানে তো আর গঙ্গাজল পাবি না। ওটাই করিস।
এইটুকু বলে সাধুবাবা হেলান দিলেন গাছের গোড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে ওদেরই একজন পরনে ময়লা ছেঁড়া জামাকাপড়, ভদ্রলোক বললেন,
– বাবা সংসারে আমার অভাব অনটন আর বাচ্চা বউ–এর রোগভোগ লেগেই আছে। দয়া করে এমন কিছু দিন যাতে এই কষ্টের হাত থেকে মুক্তি পাই।
একথা শোনামাত্রই সাধুবাবার মুখমণ্ডলটা দয়ায় ভরে উঠল। মনে হল, অন্তরে যেন ব্যথার সৃষ্টি হল। করুণাঘন কণ্ঠে তিনি বললেন,
– আমি তো নিজেই ফকির রে, একেবারেই ভিখিরি। দেবার মতো আমার কিছু নেই। তোদের মতো যারা, তাদের দয়াতেই তো প্রাণটা আমার কাছে। তোরাই তো আমার দেবতা। তোদের কি দিই বলতো?
এ কথায় দু’চোখ জলে ভরে উঠল গ্রাম্য ভদ্রলোকটির। সাধুবাবার পা দুটো ধরে বললেন,
– না বাবা, কোনও কথাই শুনব না আমি। একটা কিছু দিতেই হবে, নইলে আর বাঁচব না। সংসারটা আমার শেষ হয়ে যাবে। কিছু একটা করে না দিলে আমি কিছুতেই পা ছাড়ব না।
বলে চুপ করে বসে রইলেন পা দুটো ধরে। কাটল কিছুটা সময়। আবার সোজা হয়ে বসলেন সাধুবাবা। বুঝলাম, আজকের এই সাধুসঙ্গে জানতে পারব অনেক কথা। ভিতরে ভিতরে আনন্দিত হয়ে উঠলাম। খুশিতে ভরে উঠল মনটা। উচ্ছ্বসিত হয়ে একটা বিড়ি বের করে বললাম,
– একটা বিড়ি খাবেন বাবা?
বিড়ির কথায় প্রশ্নকারীর মুখটা কেমন যেন অস্বস্তিতে ভরে গেল। কোনও কথা বললেন না সাধুবাবা। হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। মুখটা দেখে মনে হল খুব খুশি। ধরিয়ে দিলাম। বিড়িতে কয়েকটা টান দিয়ে বললেন,
– খুব জ্ঞানী ছিলেন আমার গুরুজি। এখন আর দেহে নেই। অনেক শাস্ত্র পড়াশুনা করেছিলেন তিনি। আমি নিজে ‘পড়া লিখা’ কিছুই জানি না। শাস্ত্রের কথা আর ভগবানের নাম ছাড়া তাঁর মুখে অন্য কোনও কথা ছিল না। এখন তোদের যেসব কথা বলব এসব তাঁর মুখ থেকেই আমার শোনা। অনেক কথা। কিছু বলব তোদের। তোরা যদি মেনে চলতে পারিস তাহলে সংসারে আর যাই হোক, মোটামুটি সুখ স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটে যাবে জীবনটা। এতে তোদের কল্যাণ ছাড়া অকল্যাণ কিছু হবে না।
এই পর্যন্ত বলে একটা টান দিলেন বিড়িতে। এতক্ষণ পর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– বেটা, তুই থাকিস কোথায়?
মুখে হাসির একটা প্রলেপ টেনে বললাম,
– থাকি কোলকাতায়। এখানে এসেছি জগন্নাথদর্শনে। এখন নাঙ্গাবাবার সমাধি মন্দির দর্শন করে এসেছিলাম লোকনাথ দর্শনে। আপনাকে দেখতে পেয়ে এখানে এলাম।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কথাটা শুনে। কিছুতেই পারলাম না সাধুবাবার দৃষ্টির সঙ্গে আমার দৃষ্টিকে স্থির রাখতে। চোখ নামিয়ে নিলাম। আর কোনও প্রশ্ন করলেন না। উপস্থিত সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন একনজর। শুরু করলেন,
– শোন, প্রতিদিন সকালে উঠে স্নানটা সেরে নিবি। হাজার কাজ থাকলেও এটা করবি আগে। এতে অলক্ষ্মী, অশুভ আত্মা আর প্রেতপিশাচের দৃষ্টি পড়ে না দেহে। পড়লেও তা মুছে যায়। খারাপ চিন্তা, কুস্বপ্নও মুছে যায় মন থেকে। যত অভাবেই থাকিস না কেন, চেয়েচিন্তে হলেও সাধু আর ভিখারিকে কিছু ভিক্ষে দিবি। এতে কল্যাণ হবে সংসারের। সাধু না পেলে ভিখারিকেই দিবি। তাতেও কাজ হবে।
বিড়িটা নিভে গেছে সাধুবাবার। ফেলে দিয়ে বললেন,
– যখন কোনও কথা বলবি তখন হাত-পা নাড়িয়ে বলবি না। প্রয়োজনের বেশি এতটুকুও খাবি না। এগুলো করলে অলক্ষ্মীর দৃষ্টি পড়ে। সংসারে অভাব বাড়ে। যেকোনও খাবার যত খারাপই হোক, মুখে রান্না ভাল না লাগুক, সেই খাবারের নিন্দা করিস না। খাদ্যের মধ্যেই মা লক্ষ্মীর অবস্থান। খাবারের নিন্দা করলে লক্ষ্মীর নিন্দা করা হয়। এতে জীবনে কোনও না কোনও সময় অর্থ আর অন্নকষ্ট আসে। নিন্দিত খাবার খেলে দেহ সুস্থ থাকে না। সংসারে রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়ে।
উপস্থিত শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একবার। সকলে বসে আছে স্থির হয়ে। এতটুকু নড়ছে না কেউ। এবার চোখ বুজলেন সাধুবাবা। তিনিও স্থির। বললেন, যারা আয়ু বেশি চাস তারা যেকোনও খাবার খাবি পূর্বদিকে মুখ করে। নাম যশ চাইলে দক্ষিণমুখে, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য পশ্চিম আর যারা প্রকৃতই ধর্মোন্নতি চাস তারা উত্তর দিকে মুখ করে বসে খাবি। এটা যদি প্রতিদিন করতে পারিস দেখবি, এই ফলগুলো বৃদ্ধি পেতে থাকবে আপনা থেকেই।
এবার সাধুবাবা তাকালেন মেয়েদের দিকে। ভুরুটাকে একটু উপরে তুলে বললেন,
– সংসার তো করিস, ঘরে অলক্ষ্মী কোথায় বাস করে জানিস?
উপস্থিত মেয়েরা একে অপরের মুখ চাওয়াচায়ি করল। তারপর সকলে মাথা নাড়িয়েও মুখে বলল,
– না বাবা, জানি না। এসব কথা তো শুনিনি কখনও!
প্রশান্তচিত্ত সাধুবাবার। বসে আছেন সাধারণভাবে, কোনও আসন করে নয়। আর এত ছেঁড়া কাপড়খানা, ভাবা যায় না। একটু অন্যমনস্ক হয়ে নড়াচড়া করলেই গোপনাঙ্গটা বেরিয়ে পড়বে। আমারই একটু অস্বস্তি হচ্ছে প্রথম থেকে মেয়েদের কথা ভেবে। যদিও তারা সকলে বিবাহিতা, তবুও। সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই সাধুবাবার। বললেন,
– ঘরে খাট বিছানার ছায়া যেখানে পড়ে আর প্রদীপ জ্বালানোর পর নিচে যেখানে অন্ধকার থাকে, সেখানেই বাস করে অলক্ষ্মী। ওই দুটো জায়গা প্রতিদিন পরিস্কার রাখবি। মুছে ফেলবি। দেখবি ঘরে অলক্ষ্মী ঠাঁই পাবে না। অশান্তি যাবে। মঙ্গল হয় সংসারের। খুব ভোরে আর সন্ধ্যাবেলায় কখনও কিছু খাবি না। প্রেত পিশাচেরা এই দুটো সময় আহার করে। ওই সময় খেলে আহারে দৃষ্টি পড়ে তাদের। ফলে দৃষ্টিতে দূষিত খাবার থেকে রোগব্যাধি আসে দেহে। মনের শান্তিও যায় নষ্ট হয়ে।
সকলের মুখের দিকে তাকালেন এবার। দেখলেন বাহ্যিক কোনও চাঞ্চল্য নেই কারও মধ্যে। ভাব দেখে বুঝলাম খুশি হলেন। বললেন,
– কষ্ট করে হলেও একটু ঘি কিনে রাখবি। অভাব থাকলে বেশি কেনার দরকার নেই। প্রতিদিন একটু করে খেতে পারলে ভাল, না পারলেও কথা নেই। খাওয়ার সময় অন্নের উপর একফোঁটা হলেও ছিটে দিয়ে নিবি। তারপর খাবি। একদিন নয়। প্রতিদিন যদি এইভাবে খাস দেখবি, আর্থিক দৈন্য কেটে যাবে ধীরে ধীরে। আসবে সচ্ছলতা। এতে ধনী হবি কিনা বলতে পারব না তবে অর্থকষ্টটা যাবে, জীবনে অভাব হবে না কখনও।
অবাক হয়ে গেলাম এই অদ্ভুত কথাটা শুনে। দরিদ্র দেশ এই ভারতবর্ষ। অনেকের চাল কেনারই পয়সা জোটা না তো ঘি কিনবে কোথা থেকে! তবুও না হয় কষ্ট করে কিনল। সামান্য একটু কাজ অথচ তার ফল এরকম হতে পারে! এটা কি করে সম্ভব? বিশ্বাস হল না তবে কোনও প্রশ্নও করলাম না। সাধুবাবা সহজ সরল সুন্দর হিন্দিতে বলে যাচ্ছেন তাঁর গুরুমুখনিঃসৃত শাস্ত্রীয় কথা। আমার মনে হল না ওড়িশাবাসী শ্রোতাদের বুঝতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে। এবার সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
কথাগুলো অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। এসব কাজগুলো যদি করিস, বিশ্বাস করে করিস তাহলে ফল পাবি। অশ্রদ্ধা ও অভক্তিতেও যদি করিস, তাহলেও ফল পাবি। ফলের কোনও মার নেই এ কাজে। তবে দু-দশদিন করে ছেড়ে দিলে কিছু হবে না। সমানে কাজগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে করলে ফল ‘জরুর মিলবে’।
একদম চুপসে গেলাম। আমার মনের ভাবটা বুঝতে পেরেই হয়ত সাধুবাবা কথাটা বললেন। একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন,
– অকারণে, অপ্রয়োজনে শুবিনা। এতে রোগকে ডেকে আনা হয়। নখ বা কোনও কিছু দিয়ে মাটিতে আঁকবি না। মনের শান্তি নষ্ট হয় আর ঋণ হয়। যাদের উপরে অলক্ষ্মীর দৃষ্টি থাকে, তারা নখ দিয়ে ঘাস ছেঁড়ে কারণে অকারণে বেশি হাসে, নিজের শরীরে বা আসনে বাজনা বাজায়। এসব করবি না কখনও। তাতে লক্ষ্মীলাভ হবে। প্রতিদিন পা দুটো বেশ ভাল করে ধুবি, পরিস্কার রাখবি। এতে যে কাজে যাবি সেই কাজ সিদ্ধি হবে। ভিজে পায়ে অন্নগ্রহণ করবি, আয়ু দীর্ঘ হবে। কিন্তু ভিজে পায়ে শুবি না, রোগে ধরবে।
কথাটা বলে একবার একটু এদিক ওদিক তাকালেন। অসংখ্য তীর্থযাত্রী আসছে যাচ্ছে লোকনাথমন্দিরে। কোনওদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই সাধুবাবার। আর সব শ্রোতাদের অবস্থাও তাই। এক মনে স্থির হয়ে কথা শুনছে সকলে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন,
– তোর কাছে বিড়ি থাকে তো একটা দে।
বলে হাত বাড়ালেন। ‘হ্যাঁ বাবা, আছে’ বলে একটা বিড়ি বের করে দিলাম। দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে ধরলাম মুখের কাছে। কয়েকটা টান দিয়ে বললেন,
– শোন, ঘরের বউ যখন সাজগোজ করবে কিংবা অনাবৃত দেহে থাকবে তখন দেখবি না সেদিকে। এতে বীর্য চঞ্চল হয় পুরুষের। তেজ নষ্ট হয়ে যায়। একবস্ত্র পরে খাবি না। পিতৃমাতৃ শ্রাদ্ধের সময় একবস্ত্র করে খাওয়ার নিয়ম। একবস্ত্রে খেলে শ্রাদ্ধের খাওয়া হয়। এতে দেহমন ও সংসারের অকল্যাণ হয়।
সাধুবাবা মুখে একটু হাসির রেশ টেনে বললেন,
– ঘেরা জায়গায় অনেক সময় তোরা উলঙ্গ হয়ে স্নান করিস। রমণের সময়েও স্ত্রীকে বিবস্ত্র করে নিস। এটা কখনও করবি না। এতে প্রেতের বা অশুভ আত্মার দৃষ্টি পড়ে দেহে। কালক্রমে দেহ হবে রোগগ্রস্ত। মন হয়ে উঠবে অশান্তিময়। শরীর মন দুটোই ভোগাবে। উলঙ্গ হয়ে ঘুমলেও ওই একই ফল। আগুন চন্দ্র সূর্য জল ও গরু, এদের সামনে রেখে মলমূত্র ত্যাগ করবি না। এতে বুদ্ধি নষ্ট হয়। মূত্রাশয় সংক্রান্ত রোগে একদিন না একদিন ভুগতেই হবে।
বলে চুপ করে রইলেন। মিনিটখানেক গেল। কি যেন একটু ভেবে বললেন,
– কিছু মনে করিস না তোরা, আজকাল জন্মের পর থেকেই ছেলেপুলেরা ভুগতে থাকে নানা রোগে। সুস্থ নেই কেউ। কেন জানিস, সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে রমণের সময় স্ত্রীর দেহের উপর পড়ে অশুভ আত্মা বা প্রেতের দৃষ্টি। এটা তোরা চোখে দেখতে পাবি না কিন্তু সত্য। তখন পেটে সন্তান এলে তার উপরেও সেই প্রভাবটা থেকে যায়। ফলে জন্মের পর সন্তানের দেহ মন শিক্ষা, সবেতেই ভোগান্তি হয়। সেইজন্যেই তো বেশিরভাগ ঘরের ছেলেমেয়েরা আজকাল আর মানুষ হয় না, কোনও কিছুই এদের সুন্দর, সুস্থ নয়।
আমরা সকলে শ্রোতা। কথা শুনছি একমনে। হঠাৎ পাখির বিষ্ঠা পড়ল একজনের কাঁধে। একটু অস্বস্তি বোধ করলেন ভদ্রলোক। তবে মুছে ফেলার চেষ্টা করলেন না। সাধুবাবাও দেখলেন। বললেন,
– পাখিতে খেয়েছে এমন ফল খাবি না। পা লেগেছে এমন অন্নও পরিত্যাগ করবি। যে কোনওভাবে পায়ে ঠেকে যাওয়া ফলফুল ইত্যাদিও দেবতার ভোগে দিবি না। এতে নিজের ও সংসারের অকল্যাণ হবে। কারও উচ্ছিষ্ট খাবার, হোটেল এবং লাইন দিয়ে খাওয়া মহোৎসবের অন্নও খেতে নেই। একেবারে সত্যি জানবি, এতে অন্যের পাপ সংক্রমিত হয়। কুকুরের ছোঁয়া আর গরু শুঁকেছে এমন খাদ্যও খাবি না কোনওদিন।
প্রায় নিভে আসা বিড়িটা ফুকফুক করে টানলেন কয়েকবার। আগুনের আলোটা বেড়ে গেল। ধোঁয়াও বাড়ল। শেষে লম্বা করে একটা সুখটান দিয়ে ফেলে দিলেন। বললেন,
– যদি দেহ মন, আধ্যাত্মিকজীবন আর সংসারের কল্যাণ চাস তাহলে একমাত্র মা-বাবার শ্রাদ্ধ ছাড়া কারও শ্রাদ্ধের অন্ন-জল কখনও গ্রহণ করবি না। শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ খেলে দারুণ অকল্যাণ হয় সংসারজীবন, দেহমনের। ধর্মীয়জীবনের অবনতিও অনিবার্য। দেবতার উদ্দেশ্যের নিবেদিত ভোগকে প্রসাদ বলে খেলে সার্বিক কল্যাণ হয়। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে (শ্রাদ্ধ) নিবেদিত ভোগকে বলে প্রেতের ভোগ। প্রেতাত্মার দৃষ্টি পড়ে খাদ্যে। এই খাদ্যগ্রহণে দেহ রোগগ্রস্ত ও মনের শুদ্ধতা নষ্ট হয়। অশান্তি বাড়ে। বিবাহ অনুষ্ঠানের ভোগকে কামভোগ বলে। খাবি না কখনও। এতে মনে কামচিন্তা ও ভোগবাসনা বাড়ে।
মনে মনে ভাবছি, নিজে সংসারী হলেন না অথচ সংসারীদের সুখের জন্য কত কথাই জানেন সাধুবাবা! আর সংসারে থেকে সাংসারিক সুখলাভের জন্য কোনও খবরই রাখি না আমরা। এবার বললেন,
– পরের ঘরে খাওয়া আর পরের বিছানায় শোওয়া ভাল না। সুযোগ পেলেও অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে কখনও রমণ করবি না। অন্যের গা ছুঁয়ে কথা বলা, কয়েকজন একসঙ্গে বসে এক পাত্রে খাওয়া, এক আসনে (কাঠের আসন ছাড়া) কয়েকজন বসা, খুব কাছাকাছি কারও সঙ্গে বসে কথা বলা, এসবগুলো পরিত্যাগ করবি। একেবারে নিশ্চিত জানবি অন্যের পাপ দ্রুত সংক্রামিত হয় এসব কাজে।
এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর মুখ খুললাম,
– বাবা, আমরা সংসারী মানুষ। আপনার উপদেশ মতো কিছু কাজ করা সম্ভব। কিন্তু সংসারে থেকে সব কিছু এড়িয়ে চলা কি সম্ভব?
মাথা নাড়িয়ে স্বীকারোক্তি করেও বললেন,
– হ্যাঁ বেটা, একটু অসুবিধে হবে বটে তবে সচেষ্ট হলে এগুলো সবই সম্ভব হত। আসলে কি জানিস, এসব বিষয়গুলো অনেকের জানা নেই। জানলেও মেনে চলে না, ধৈর্যেরও বড় অভাব। ফলে সংসারীরা কোনও না কোনওভাবে ভুগছে, ভুগবেও।
একথার কোনও উত্তর দিলাম না। প্রশ্নও করলাম না। তিনি বলে চললেন,
– পূর্বজন্মের পুণ্যফল নষ্ট হয় যদি ঝাঁটার ধুলো, কুলোর বাতাস আর চুলধোয়া জল গায়ে লাগে। মঙ্গল হবে গরুর গা ঝাড়া আর ধানের ধুলো গায়ে লাগলে। দীক্ষিত ব্যক্তি জপের আসনে বসে কাশলে, হাঁচি দিলে, হাই তুললে অথবা বায়ুত্যাগ করলে উপাস্য দেবতা ক্ষুব্ধ হন। তাই জপের সময় এর কোনওটা হলে ডানহাত দিয়ে ডানকান স্পর্শ করলে দোষ খণ্ডন হয়।
এবার একটা অদ্ভুত কথা বললেন সাধুবাবা,
– সংসারে আছিস। কিন্তু কোনও শিশুর বা কারও নাম কোনও দেবদেবীর নামে রাখবি না।
কথা শুনে উপস্থিত সকলে একে অপরের মুখ চাওয়া চাইয়ি করলাম। কোনও দেবদেবীর নামে কারও নাম রাখা চলবে না, বলে কি সাধুবাবা! জানতে চাইলাম,
– কেন বাবা, দেবদেবীর নাম রাখা তো ভালই। তাতে দোষটা কোথায়?
অনেকক্ষণ একভাবে বসে থাকার পর এবার বসলেন একটু নড়েচড়ে। তারপর বললেন,
– দেবদেবীর নাম ভাল, তবে সংসারীদের না রাখাই ভাল। কেন জানিস? নামের সঙ্গে নামী অভেদ। কি রকম ধর, একজনের নাম রাখলি লক্ষ্মী। কোনও কারণে মেয়েটি কোনও অন্যায় বা অপরাধ করল। এটা সংসারে থাকলে করতেই পারে। তখন লক্ষ্মী নামকে সম্বোধন করে কেউ কুবাক্য প্রয়োগ বা গালমন্দ করল। এটা করল মনুষ্যরূপী একটা দেহকে লক্ষ্য করে। আসলে কিন্তু শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে পরোক্ষে গিয়ে কুবাক্য আঘাত করে নামী অর্থাৎ দেবীকে। কারণ শব্দ ব্রহ্ম। মানুষ লক্ষ্য হলেও পরোক্ষে রুষ্ঠা হন দেবী। এতে মেয়েটির সংসারজীবনের শান্তি নষ্ট হয়।
এখন সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– একটু লক্ষ্য করলেই তোরা দেখতে পাবি, দেবদেবীর নামের ছেলে বা মেয়েরা একটাও সংসারজীবনে শান্তিতে নেই। দেবদেবীর নাম রাখায় আপত্তি নেই। তবে নামের উপর কোনও আঘাত না হলেই ভাল। তাতে কল্যাণ হয় কিন্তু সংসারে থাকলে তা হওয়ার উপায় নেই।
মুখে একটু হাসির ভাব নিয়ে বললেন,
– অনেকেরই অভ্যাস আছে কোনও শুভ কাজ করার আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলে বেড়ানো। তা করবি না। শুভ বা ভাল কাজের বিষয় যত গোপন রাখবি, তার সিদ্ধি তত তাড়াতাড়ি। কাজ হওয়ার আগে বলে বেড়ালে সেই কাজে বিঘ্ন নইলে বিলম্ব ঘটে। আবার অনেক সময় সে কাজ পণ্ডই হয়ে যায়।
সাধুবাবা না থেমে বললেন,
– দেবদেবীর স্বপ্ন তো অনেকেই দেখে থাকিস। বলবি না কাউকে। স্বপ্নের সুফল নষ্ট হয়। যেকোনও খারাপ স্বপ্ন দেখলে সবাইকে ডেকে বলে দিতে হয়। তাতে দুঃস্বপ্নের কুফল নষ্ট হয়ে যায়। আর সাধনভজন জীবনের কথা, অলৌকিক দর্শন, কোনও ঈশ্বরীয় অনুভূতির কথা বলতে নেই কাউকে। এমনকি স্ত্রীরও উচিত নয় স্বামীকে বলা। এতে ভগবানের কৃপা নষ্ট হয়। বলে দিলে ওগুলো ধীরে ধীরে সব বন্ধ হয়ে যায়।
মোহিত হয়ে শুনতে লাগলাম সাধুবাবার কথা। শুনছে এখানে উপস্থিত ওড়িশাবাসীরাও। কারও মুখে একটা কথাও নেই। একেবারে স্থির হয়ে বসে আছে সকলে। সাধুবাবা বললেন,
– কোনও খাবার বিছানায় বসে খাবি না। এতে রোগব্যাধিকে আহ্বান করা হয়। আসনের উপর খাবার রেখে অথবা হাতের মধ্যে খাবার বেশি করে নিয়ে তা ধীরে ধীরে খেতে নেই। এতে লক্ষ্মী চঞ্চলা হয়। স্বামী–স্ত্রী একসঙ্গে বসে আহার করবি না। এতে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও সংসারে সারাটা জীবন শান্তিটা থাকবে না।
এবার কিছু উপদেশমূলক কথা বললেন,
– যতই ভোগ করিস না কেন, এর তৃষ্ণা কখনও মেটে না। কামনাও নিঃশেষ হয় না। ভোগবাসনা নিবৃত্তি হয় সংযমে। মানসিক শান্তির উৎসই হল সংযম। কারও মনে আঘাত দিবি না। সংসারে সব সময় অপমান সহ্য করতে অভ্যাস করবি। এগুলো সব অভ্যাস যোগ। সামান্য চেষ্টাতেই সফল হওয়া যায়। এই যোগ রপ্ত করতে পারলে মনে শান্তি পাবি।
অত্যন্ত জোর দিয়ে বললেন,
– অধর্মের পথে বেটা প্রথম অবস্থায় ধন সম্পদ নাম যশ খ্যাতি সব, সব বাড়ে। সংসার ভরে ওঠে। নিজে অন্যায় করেও জয়ী হয়। কিন্তু নিশ্চিত জানবি, এসব একেবারেই সাময়িক। ভগবানের কাছে এর কোনও ক্ষমা নেই। হঠাৎ একদিন তার জীবনে দুর্যোগ আসবেই আসবে। সমূলে ধ্বংস হবেই হবে। এর অন্যথা হবার নয়। একটা কথা মনে রাখিস তোরা, ভগবানের অপার করুণা থাকলে তবেই মানুষ হাসতে পারে প্রাণ খুলে, পারে নিশ্চিন্তে ঘুমতে। তাঁর এই কৃপাটুকু সংসারে থেকে সহজেই পেয়ে যাবি যদি অধর্ম অসৎপথের আশ্রয় না নিস।
একটা রোগের জন্য ওষুধ জানতে চাইলাম,
– বাবা, আমার পরিচিত দুজনকে জানি, যারা বহুদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছে মৃগীরোগে। আপনার কি এ রোগের কোনও ওষুধ জানা আছে?
কথাটা শোনামাত্রই বললেন,
– হাঁ বেটা, এই রোগের ওষুধ আছে। শনি অথবা মঙ্গলবারে সকালে স্নান করার আগে, নিঃশ্বাস বন্ধ করে একটানে কৃষ্ণতুলসীর গাছ তুলে শিকড়টা ডানহাতে কালো কার দিয়ে ধারণ করলে, যতদিনের মৃগীরোগ হোক না কেন – আরোগ্য হবে। হিস্টিরিয়া হলে কিন্তু ভাল হবে না। স্নান করার পর ধারণ করবে। এতে আর কোনও নিয়ম নেই।
আরও অনেক, অনেক কথাই বলেছিলেন সংসারীদের কল্যাণের জন্যে। পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে ভেবে আর এগোলাম না। এসব কথার পর জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, এটা করলে ভাল, ওটা করলে ভাল নয়, এমন অনেক কথাই তো বললেন। প্রায় কথারই তো কোনও কারণ বা ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না, কেন এটা হবে? যেমন ধরুন ঘি দিয়ে প্রতিদিন ভাত খেলে ধীরে ধীরে অভাব চলে যাবে, এটা কেমন করে সম্ভব? মন তো এসব কথা মেনে নিতে চায় না। এর ব্যাখ্যা কি, কারণটাই বা কি?
উত্তরে সাধুবাবা বললেন,
– একটা ডাবগাছে অনেক ডাব হয়ে আছে। গাছের তলায় বসে আছে একটা শিশু তার বাবার সঙ্গে। শিশু কখনও ডাব দেখেনি। বাবার কাছে প্রথম শুনল ডাব এমনই একটা ফল, যার মধ্যে শাঁস আর মিষ্ট জল আছে। শিশুর বিশ্বাস হবে না এককথায়। তার মনে হবে, এটা কি করে সম্ভব? বাবা কিন্তু জানে এটাই সত্য। কারণ সে জল ও শাঁস দুটোই খেয়েছে। বাবার পক্ষে এটা জানা সম্ভব হয়েছে গাঁছি ডাব পেড়ে দিয়েছিল বলে। তবে বাবা কিন্তু এটা জানে না ডাবের ভিতরে শাঁস আর জল সৃষ্টি হয় কেমন করে?
বেটা, প্রাচীন ভারতের ঋষিরা হলেন গাঁছি। তাঁরা ডাব পেড়ে দিয়েছেন, যাঁরা খেয়েছেন তাঁদের মুখ থেকে পরম্পরা চলে আসছে। পরম্পরাই হল বাবা সত্যতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ। না খেলে জানবি কেমন করে ওর ভিতরে শাঁস আর জলের কথা। আমরা তো শিশু। আমিও জানি না, তুইও জানিস না ডাবের ভিতরে শাঁস জল সৃষ্টি হচ্ছে কেমন করে! এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোনও প্রশ্ন নেই। ডাবে শাঁস জল হচ্ছে, এটাই চিরন্তন সত্য।
অনেক কথাই শুনলাম সংসারীদের বিষয়ে। সাধুবাবা চুপ করে বসে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। বিরক্ত করলাম না। বসে রইলাম। আর সকলে নড়ছে না কেউই। কথাও বলছে না। সাধুবাবাই বললেন,
– এবার তোরা যা। আমি একটু বিশ্রাম করি।
দুপুরে খাওয়া হয়নি আমার। যখন সাধুবাবার কাছে বসেছি, তখন বেলা প্রায় দশটা। এখন ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে বারোটা। যারা বসেছিলেন তারা সকলে একে একে উঠে পড়লেন প্রণাম করে। এক ভদ্রমহিলার ছেঁড়া আঁচলে বাঁধা ঠোঙায় ছিল খানচারেক রুটি। চিনিও ছিল একটু। রাখলেন সাধুবাবার পায়ের কাছে। বার বার অনুরোধ করলেন খাওয়ার জন্য। খাবেন কথা দিলেন সাধুবাবা। খুব খুশি হয়ে চলে গেলেন তিনি। তবে প্রত্যেকেই ‘পরে আবার আসব’ বলে গেলেন। সকলে চলে গেলেও আমি কিন্তু গেলাম না। খিদেও পেয়েছে খুব। ভাবলাম, খেতে গেলে সাধুবাবা যদি চলে যান, উদ্দেশ্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে আমার। তাই বসে রইলাম। আমাকে উঠতে না দেখে বললেন,
– কি রে বেটা, তুই গেলি না? বেলা যে অনেক হল। কিছু খাবি না, খিদে পায়নি তোর?
নিঃসংকোচেই বললাম,
– হ্যাঁ বাবা, খিদে পেয়েছে তবে দেরি আছে, একটু পরে খাব। কিছু কথা আছে আপনার সঙ্গে।
একটু ঝুঁকে পড়ে দুটো রুটি আমার হাতে দিয়ে বললেন,
– লে বেটা, খা লে।
আমিও বললাম,
– আপনিও খান বাবা।
সাধুবাবা নিজে তুলে নিলেন দুটো রুটি। খাওয়া শুরু করলেন কোনও কথা না বলে, আমিও। খাওয়া শেষ হলে কাছের কল থেকে জল খেয়ে এলাম। সাধুবাবাকে বললাম জলের কথা। ‘না’ করলেন ঘাড় নেড়ে। মিনিট পনেরো বিশ্রামের পর বললেন,
– তোর কি কথা আছে বলছিলি?
মুখে হাসি হাসি ভাব রেখে বললাম,
– একটু আগেই তো বললেন, সকালবেলায় প্রতিদিন স্নান করলে অলক্ষ্মীর দৃষ্টি পড়ে না। তা আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে বহুকাল স্নান তো দূরের কথা জলের ধারেও যাননি। আপনার উপরে কি লক্ষ্মীর দৃষ্টি আছে?
কথাটা শুনে হাসতে হাসতে বললেন,
– আমি তো বেটা সাধু। আমার না আছে ঘরদোর, না আছে সংসার। আমার লক্ষ্মীও নেই, অলক্ষ্মীও নেই। কোনওটার দরকারও নেই। সাধুরা কখনও লক্ষ্মীর উপাসনা করে না। গুরুর উপর ছেড়ে দিয়ে পড়ে থাকলে লক্ষ্মী আপনিই আসে। দয়াও করে। এতেই আজকের দিনটা চলে যাবে আমার।
লেখক- শিবশংকর ভারতী
ভারতের সাধক ও সাধিকা
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নূতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নূতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।
ভারতের সাধক ও সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত
প্রণয় সেন
প্রণয়
যখন কোথাও ভ্রমণে যাই তখন সঙ্গী থাকে অনেক ভ্রমণেই। যখন সাধুসন্ন্যাসী খুঁজে বেড়াই বা সাধুসঙ্গ করি তখন কোনও সঙ্গীকে নিই না সঙ্গে। কারণ ওদের ধৈর্য কম। তাড়া দিতে থাকে। কথা বলা যায় না। উদ্দেশ্যটাও নষ্ট হয় আমার, তাই সঙ্গী নিই না। এখন বেড়িয়েছি একা।
আজ থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। ফিরছি নাঙ্গাবাবার আশ্রম থেকে। আসার পথে পড়ে লোকনাথ মন্দির। এই মন্দিরে যাওয়ার পথের দুধারেই বিশাল বিশাল অশ্বত্থ আর তেঁতুল গাছ। অনেকটা জায়গা জুড়ে বেশ বাগানের পরিবেশ। মন্দিরের একটু আগেই একটা অশ্বত্থগাছের গোড়ায় দেখি জনাদশেক নারীপুরুষ বসে আছে বিভিন্ন বয়সের। সবাই বসে আছে এক সাধুবাবাকে ঘিরে। সাধুবাবাও বসে আছেন গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে। এসব লক্ষ্য করলাম দূর থেকেই। বুঝলাম ওখানে একটা কিছু ব্যাপার আছে। রিকশা ছেড়ে দিলাম ভাড়া মিটিয়ে।
কৌতূহল আমার আজ না, বরাবরই। তাই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। অনেকটা কাছাকাছি হলাম ওদের। উপস্থিত সকলে তাকালেন আমার মুখের দিকে। কেউ কোনও কথা বললেন না। তবে সকলেই যে একটু বিরক্ত হলেন মুখের ভাব দেখে তা বুঝলাম। আরও বুঝলাম, অনেকক্ষণ ধরে কথা হচ্ছে ওদের। আমার উপস্থিতিতে চুপ করে গেলেন সাধুবাবা।
সাধু আমি বহু দেখেছি, তবে এমন সাধু এই প্রথম। পরনের কাপড়টা একেবারে শতচ্ছিন্ন হাঁটু পর্যন্ত। নোংরা আর কাকে বলে! এত নোংরা, উদাহরণেও আনা যায় না। গালভর্তি কাঁচায় পাকায় দাড়ি। খোঁচাখোঁচা অথচ বড়। দাড়ি বড় অথচ খোঁচা খোঁচা এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। একমাথা ঝাঁকড়া চুল একেবারেই এলোমেলো। ঝোড়ো কাকের বাসা যেন। চুলগুলো ময়লাতে জটাজটা লাগছে। গায়ের রঙও ময়লা। একে ময়লা, তার উপরে দীর্ঘকাল স্নান করেনি, ফলে দশাটাও যেমন হয় তেমনই। গায়ে গলায় কিছুই নেই। একটা মালা পর্যন্ত নয়। কপালে তিলক টিলকও কিছু নেই। পাশে একটা ছোট্ট পোঁটলা। কাঁধে ঝোলানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। মনে হয় বগলদাবা করে নিয়েই পথ চলতে হয়। দেখলে পাগল কিংবা না খাওয়া ভিখারি ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। অন্তত অন্যে তাই ভাববে। সাধুবাবার ভাবে বুঝলাম, এসব কথা তাঁর ভাবার অবকাশ নেই। সাধু ভেবে শ্রদ্ধা তো দূরের কথা, কথা বলারও প্রবৃত্তি হবে না কারও। তবুও সকলের পাশ কাটিয়ে গিয়ে প্রণাম করলাম। দাঁড়ালাম সাধুবাবার বাঁপাশে।
একবার মুখের দিকে তাকালেন। বসতে বললেন ইশারায়। এই তাকানোতেই সর্বাঙ্গে একটা শিহরণ খেলে গেল আমার। চোখ আমি বহু সাধুরই দেখেছি, তবে এমন চোখ দেখলাম এই প্রথম। ভিতর থেকে যেন বিদ্যুতের আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। তাকানো যায় না চোখের দিকে। দেহের বিষয় যাইহোক, চোখদুটো দেখে বুঝলাম এ সাধুবাবা উচ্চমার্গের কোনও মহাত্মা হবেন।
বসলাম, সাধুবাবার ইশারাতেই বসলাম। মাটিতে আর সকলে যেমন বসে আছে। এখনও একটা কথাও শুনিনি। তাই বুঝতে পারছি না কোন ভাষাভাষীর লোক। আমার আসাতে এখানকার পরিস্থিতিটা একটু অন্য রকম হয়েছিল। সাধুবাবা বসতে বলায় আবার আগের অবস্থাটাই ফিরে এল ধীরে ধীরে। রাজা সরাসরি কাউকে গ্রহণ করলে পার্ষদদের কিছু বলার থাকে না, এখানেও ঠিক তাই হল।
একটা কথাও বললাম না। সাধুবাবাকে ঘিরে রয়েছে যারা তাদের চেহারা দেখে বুঝলাম, প্রত্যেকেই ওড়িশাবাসী। ছজন মহিলা, পুরুষ চারজন। এদের পোশাক দেখে মনে হল বেশ দরিদ্র। ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে এক মহিলা বললেন,
– বাবা, আমার কথাটার উত্তর দিলেন না?
একটু আনমনা হয়ে বললেন,
– কি যেন বলেছিলি?
এবার কথাতে বুঝতে পারলাম সাধুবাবা হিন্দিভাষী। ওই মহিলা বললেন,
– ওই যে বললাম প্রায় রাতেই স্বপ্ন দেখি। কখনও ভূতপ্রেত, কখনও ভয়ের আবার কখনও দেখি আজেবাজে স্বপ্ন যার মাথামুণ্ডু নেই। ভীষণ ভয় পাই। দয়া করে এমন একটা কিছু দিন যাতে ওসব বন্ধ হয়ে যায়।
একমুহুর্ত কি যেন চিন্তা করলেন সাধুবাবা। বসলেন সোজা হয়ে। কোনও কথা না বলে সকলকে দেখছি – দেখছি সাধুবাবাকেও। আমার উপস্থিতিতে প্রাথমিক অস্বস্তিটা কেটে গেছে ইতিমধ্যেই। তিনি বললেন,
– রবি আর বৃহস্পতিবার বাদ দিবি। সকাল থেকে বেলা বারোটার মধ্যে একটা তুলসী পাতা তুলবি বোঁটা সমেত। বাড়িতে গাছ না থাকলে কেনা তুলসীপাতা হলেও চলবে। এবার তুই যে বালিশে মাথা রেখে ঘুমাস, সেই বালিশের ওয়াড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দিবি। একদিনই রাখবি। ব্যস, ধীরে ধীরে দেখবি কুস্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে যাবে। খেয়াল করবি, পাতাটা যেন ভিতর থেকে বেরিয়ে না পড়ে যায়। প্রতিদিন বিছানায় শুধু গঙ্গার জল ছিটিয়ে ঘুমলেও ওই একই ফল হবে। এখানে তো আর গঙ্গাজল পাবি না। ওটাই করিস।
এইটুকু বলে সাধুবাবা হেলান দিলেন গাছের গোড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে ওদেরই একজন পরনে ময়লা ছেঁড়া জামাকাপড়, ভদ্রলোক বললেন,
– বাবা সংসারে আমার অভাব অনটন আর বাচ্চা বউ–এর রোগভোগ লেগেই আছে। দয়া করে এমন কিছু দিন যাতে এই কষ্টের হাত থেকে মুক্তি পাই।
একথা শোনামাত্রই সাধুবাবার মুখমণ্ডলটা দয়ায় ভরে উঠল। মনে হল, অন্তরে যেন ব্যথার সৃষ্টি হল। করুণাঘন কণ্ঠে তিনি বললেন,
– আমি তো নিজেই ফকির রে, একেবারেই ভিখিরি। দেবার মতো আমার কিছু নেই। তোদের মতো যারা, তাদের দয়াতেই তো প্রাণটা আমার কাছে। তোরাই তো আমার দেবতা। তোদের কি দিই বলতো?
এ কথায় দু’চোখ জলে ভরে উঠল গ্রাম্য ভদ্রলোকটির। সাধুবাবার পা দুটো ধরে বললেন,
– না বাবা, কোনও কথাই শুনব না আমি। একটা কিছু দিতেই হবে, নইলে আর বাঁচব না। সংসারটা আমার শেষ হয়ে যাবে। কিছু একটা করে না দিলে আমি কিছুতেই পা ছাড়ব না।
বলে চুপ করে বসে রইলেন পা দুটো ধরে। কাটল কিছুটা সময়। আবার সোজা হয়ে বসলেন সাধুবাবা। বুঝলাম, আজকের এই সাধুসঙ্গে জানতে পারব অনেক কথা। ভিতরে ভিতরে আনন্দিত হয়ে উঠলাম। খুশিতে ভরে উঠল মনটা। উচ্ছ্বসিত হয়ে একটা বিড়ি বের করে বললাম,
– একটা বিড়ি খাবেন বাবা?
বিড়ির কথায় প্রশ্নকারীর মুখটা কেমন যেন অস্বস্তিতে ভরে গেল। কোনও কথা বললেন না সাধুবাবা। হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। মুখটা দেখে মনে হল খুব খুশি। ধরিয়ে দিলাম। বিড়িতে কয়েকটা টান দিয়ে বললেন,
– খুব জ্ঞানী ছিলেন আমার গুরুজি। এখন আর দেহে নেই। অনেক শাস্ত্র পড়াশুনা করেছিলেন তিনি। আমি নিজে ‘পড়া লিখা’ কিছুই জানি না। শাস্ত্রের কথা আর ভগবানের নাম ছাড়া তাঁর মুখে অন্য কোনও কথা ছিল না। এখন তোদের যেসব কথা বলব এসব তাঁর মুখ থেকেই আমার শোনা। অনেক কথা। কিছু বলব তোদের। তোরা যদি মেনে চলতে পারিস তাহলে সংসারে আর যাই হোক, মোটামুটি সুখ স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটে যাবে জীবনটা। এতে তোদের কল্যাণ ছাড়া অকল্যাণ কিছু হবে না।
এই পর্যন্ত বলে একটা টান দিলেন বিড়িতে। এতক্ষণ পর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– বেটা, তুই থাকিস কোথায়?
মুখে হাসির একটা প্রলেপ টেনে বললাম,
– থাকি কোলকাতায়। এখানে এসেছি জগন্নাথদর্শনে। এখন নাঙ্গাবাবার সমাধি মন্দির দর্শন করে এসেছিলাম লোকনাথ দর্শনে। আপনাকে দেখতে পেয়ে এখানে এলাম।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কথাটা শুনে। কিছুতেই পারলাম না সাধুবাবার দৃষ্টির সঙ্গে আমার দৃষ্টিকে স্থির রাখতে। চোখ নামিয়ে নিলাম। আর কোনও প্রশ্ন করলেন না। উপস্থিত সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন একনজর। শুরু করলেন,
– শোন, প্রতিদিন সকালে উঠে স্নানটা সেরে নিবি। হাজার কাজ থাকলেও এটা করবি আগে। এতে অলক্ষ্মী, অশুভ আত্মা আর প্রেতপিশাচের দৃষ্টি পড়ে না দেহে। পড়লেও তা মুছে যায়। খারাপ চিন্তা, কুস্বপ্নও মুছে যায় মন থেকে। যত অভাবেই থাকিস না কেন, চেয়েচিন্তে হলেও সাধু আর ভিখারিকে কিছু ভিক্ষে দিবি। এতে কল্যাণ হবে সংসারের। সাধু না পেলে ভিখারিকেই দিবি। তাতেও কাজ হবে।
বিড়িটা নিভে গেছে সাধুবাবার। ফেলে দিয়ে বললেন,
– যখন কোনও কথা বলবি তখন হাত-পা নাড়িয়ে বলবি না। প্রয়োজনের বেশি এতটুকুও খাবি না। এগুলো করলে অলক্ষ্মীর দৃষ্টি পড়ে। সংসারে অভাব বাড়ে। যেকোনও খাবার যত খারাপই হোক, মুখে রান্না ভাল না লাগুক, সেই খাবারের নিন্দা করিস না। খাদ্যের মধ্যেই মা লক্ষ্মীর অবস্থান। খাবারের নিন্দা করলে লক্ষ্মীর নিন্দা করা হয়। এতে জীবনে কোনও না কোনও সময় অর্থ আর অন্নকষ্ট আসে। নিন্দিত খাবার খেলে দেহ সুস্থ থাকে না। সংসারে রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়ে।
উপস্থিত শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একবার। সকলে বসে আছে স্থির হয়ে। এতটুকু নড়ছে না কেউ। এবার চোখ বুজলেন সাধুবাবা। তিনিও স্থির। বললেন, যারা আয়ু বেশি চাস তারা যেকোনও খাবার খাবি পূর্বদিকে মুখ করে। নাম যশ চাইলে দক্ষিণমুখে, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য পশ্চিম আর যারা প্রকৃতই ধর্মোন্নতি চাস তারা উত্তর দিকে মুখ করে বসে খাবি। এটা যদি প্রতিদিন করতে পারিস দেখবি, এই ফলগুলো বৃদ্ধি পেতে থাকবে আপনা থেকেই।
এবার সাধুবাবা তাকালেন মেয়েদের দিকে। ভুরুটাকে একটু উপরে তুলে বললেন,
– সংসার তো করিস, ঘরে অলক্ষ্মী কোথায় বাস করে জানিস?
উপস্থিত মেয়েরা একে অপরের মুখ চাওয়াচায়ি করল। তারপর সকলে মাথা নাড়িয়েও মুখে বলল,
– না বাবা, জানি না। এসব কথা তো শুনিনি কখনও!
প্রশান্তচিত্ত সাধুবাবার। বসে আছেন সাধারণভাবে, কোনও আসন করে নয়। আর এত ছেঁড়া কাপড়খানা, ভাবা যায় না। একটু অন্যমনস্ক হয়ে নড়াচড়া করলেই গোপনাঙ্গটা বেরিয়ে পড়বে। আমারই একটু অস্বস্তি হচ্ছে প্রথম থেকে মেয়েদের কথা ভেবে। যদিও তারা সকলে বিবাহিতা, তবুও। সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই সাধুবাবার। বললেন,
– ঘরে খাট বিছানার ছায়া যেখানে পড়ে আর প্রদীপ জ্বালানোর পর নিচে যেখানে অন্ধকার থাকে, সেখানেই বাস করে অলক্ষ্মী। ওই দুটো জায়গা প্রতিদিন পরিস্কার রাখবি। মুছে ফেলবি। দেখবি ঘরে অলক্ষ্মী ঠাঁই পাবে না। অশান্তি যাবে। মঙ্গল হয় সংসারের। খুব ভোরে আর সন্ধ্যাবেলায় কখনও কিছু খাবি না। প্রেত পিশাচেরা এই দুটো সময় আহার করে। ওই সময় খেলে আহারে দৃষ্টি পড়ে তাদের। ফলে দৃষ্টিতে দূষিত খাবার থেকে রোগব্যাধি আসে দেহে। মনের শান্তিও যায় নষ্ট হয়ে।
সকলের মুখের দিকে তাকালেন এবার। দেখলেন বাহ্যিক কোনও চাঞ্চল্য নেই কারও মধ্যে। ভাব দেখে বুঝলাম খুশি হলেন। বললেন,
– কষ্ট করে হলেও একটু ঘি কিনে রাখবি। অভাব থাকলে বেশি কেনার দরকার নেই। প্রতিদিন একটু করে খেতে পারলে ভাল, না পারলেও কথা নেই। খাওয়ার সময় অন্নের উপর একফোঁটা হলেও ছিটে দিয়ে নিবি। তারপর খাবি। একদিন নয়। প্রতিদিন যদি এইভাবে খাস দেখবি, আর্থিক দৈন্য কেটে যাবে ধীরে ধীরে। আসবে সচ্ছলতা। এতে ধনী হবি কিনা বলতে পারব না তবে অর্থকষ্টটা যাবে, জীবনে অভাব হবে না কখনও।
অবাক হয়ে গেলাম এই অদ্ভুত কথাটা শুনে। দরিদ্র দেশ এই ভারতবর্ষ। অনেকের চাল কেনারই পয়সা জোটা না তো ঘি কিনবে কোথা থেকে! তবুও না হয় কষ্ট করে কিনল। সামান্য একটু কাজ অথচ তার ফল এরকম হতে পারে! এটা কি করে সম্ভব? বিশ্বাস হল না তবে কোনও প্রশ্নও করলাম না। সাধুবাবা সহজ সরল সুন্দর হিন্দিতে বলে যাচ্ছেন তাঁর গুরুমুখনিঃসৃত শাস্ত্রীয় কথা। আমার মনে হল না ওড়িশাবাসী শ্রোতাদের বুঝতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে। এবার সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
কথাগুলো অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। এসব কাজগুলো যদি করিস, বিশ্বাস করে করিস তাহলে ফল পাবি। অশ্রদ্ধা ও অভক্তিতেও যদি করিস, তাহলেও ফল পাবি। ফলের কোনও মার নেই এ কাজে। তবে দু-দশদিন করে ছেড়ে দিলে কিছু হবে না। সমানে কাজগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে করলে ফল ‘জরুর মিলবে’।
একদম চুপসে গেলাম। আমার মনের ভাবটা বুঝতে পেরেই হয়ত সাধুবাবা কথাটা বললেন। একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন,
– অকারণে, অপ্রয়োজনে শুবিনা। এতে রোগকে ডেকে আনা হয়। নখ বা কোনও কিছু দিয়ে মাটিতে আঁকবি না। মনের শান্তি নষ্ট হয় আর ঋণ হয়। যাদের উপরে অলক্ষ্মীর দৃষ্টি থাকে, তারা নখ দিয়ে ঘাস ছেঁড়ে কারণে অকারণে বেশি হাসে, নিজের শরীরে বা আসনে বাজনা বাজায়। এসব করবি না কখনও। তাতে লক্ষ্মীলাভ হবে। প্রতিদিন পা দুটো বেশ ভাল করে ধুবি, পরিস্কার রাখবি। এতে যে কাজে যাবি সেই কাজ সিদ্ধি হবে। ভিজে পায়ে অন্নগ্রহণ করবি, আয়ু দীর্ঘ হবে। কিন্তু ভিজে পায়ে শুবি না, রোগে ধরবে।
কথাটা বলে একবার একটু এদিক ওদিক তাকালেন। অসংখ্য তীর্থযাত্রী আসছে যাচ্ছে লোকনাথমন্দিরে। কোনওদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই সাধুবাবার। আর সব শ্রোতাদের অবস্থাও তাই। এক মনে স্থির হয়ে কথা শুনছে সকলে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন,
– তোর কাছে বিড়ি থাকে তো একটা দে।
বলে হাত বাড়ালেন। ‘হ্যাঁ বাবা, আছে’ বলে একটা বিড়ি বের করে দিলাম। দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে ধরলাম মুখের কাছে। কয়েকটা টান দিয়ে বললেন,
– শোন, ঘরের বউ যখন সাজগোজ করবে কিংবা অনাবৃত দেহে থাকবে তখন দেখবি না সেদিকে। এতে বীর্য চঞ্চল হয় পুরুষের। তেজ নষ্ট হয়ে যায়। একবস্ত্র পরে খাবি না। পিতৃমাতৃ শ্রাদ্ধের সময় একবস্ত্র করে খাওয়ার নিয়ম। একবস্ত্রে খেলে শ্রাদ্ধের খাওয়া হয়। এতে দেহমন ও সংসারের অকল্যাণ হয়।
সাধুবাবা মুখে একটু হাসির রেশ টেনে বললেন,
– ঘেরা জায়গায় অনেক সময় তোরা উলঙ্গ হয়ে স্নান করিস। রমণের সময়েও স্ত্রীকে বিবস্ত্র করে নিস। এটা কখনও করবি না। এতে প্রেতের বা অশুভ আত্মার দৃষ্টি পড়ে দেহে। কালক্রমে দেহ হবে রোগগ্রস্ত। মন হয়ে উঠবে অশান্তিময়। শরীর মন দুটোই ভোগাবে। উলঙ্গ হয়ে ঘুমলেও ওই একই ফল। আগুন চন্দ্র সূর্য জল ও গরু, এদের সামনে রেখে মলমূত্র ত্যাগ করবি না। এতে বুদ্ধি নষ্ট হয়। মূত্রাশয় সংক্রান্ত রোগে একদিন না একদিন ভুগতেই হবে।
বলে চুপ করে রইলেন। মিনিটখানেক গেল। কি যেন একটু ভেবে বললেন,
– কিছু মনে করিস না তোরা, আজকাল জন্মের পর থেকেই ছেলেপুলেরা ভুগতে থাকে নানা রোগে। সুস্থ নেই কেউ। কেন জানিস, সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে রমণের সময় স্ত্রীর দেহের উপর পড়ে অশুভ আত্মা বা প্রেতের দৃষ্টি। এটা তোরা চোখে দেখতে পাবি না কিন্তু সত্য। তখন পেটে সন্তান এলে তার উপরেও সেই প্রভাবটা থেকে যায়। ফলে জন্মের পর সন্তানের দেহ মন শিক্ষা, সবেতেই ভোগান্তি হয়। সেইজন্যেই তো বেশিরভাগ ঘরের ছেলেমেয়েরা আজকাল আর মানুষ হয় না, কোনও কিছুই এদের সুন্দর, সুস্থ নয়।
আমরা সকলে শ্রোতা। কথা শুনছি একমনে। হঠাৎ পাখির বিষ্ঠা পড়ল একজনের কাঁধে। একটু অস্বস্তি বোধ করলেন ভদ্রলোক। তবে মুছে ফেলার চেষ্টা করলেন না। সাধুবাবাও দেখলেন। বললেন,
– পাখিতে খেয়েছে এমন ফল খাবি না। পা লেগেছে এমন অন্নও পরিত্যাগ করবি। যে কোনওভাবে পায়ে ঠেকে যাওয়া ফলফুল ইত্যাদিও দেবতার ভোগে দিবি না। এতে নিজের ও সংসারের অকল্যাণ হবে। কারও উচ্ছিষ্ট খাবার, হোটেল এবং লাইন দিয়ে খাওয়া মহোৎসবের অন্নও খেতে নেই। একেবারে সত্যি জানবি, এতে অন্যের পাপ সংক্রমিত হয়। কুকুরের ছোঁয়া আর গরু শুঁকেছে এমন খাদ্যও খাবি না কোনওদিন।
প্রায় নিভে আসা বিড়িটা ফুকফুক করে টানলেন কয়েকবার। আগুনের আলোটা বেড়ে গেল। ধোঁয়াও বাড়ল। শেষে লম্বা করে একটা সুখটান দিয়ে ফেলে দিলেন। বললেন,
– যদি দেহ মন, আধ্যাত্মিকজীবন আর সংসারের কল্যাণ চাস তাহলে একমাত্র মা-বাবার শ্রাদ্ধ ছাড়া কারও শ্রাদ্ধের অন্ন-জল কখনও গ্রহণ করবি না। শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ খেলে দারুণ অকল্যাণ হয় সংসারজীবন, দেহমনের। ধর্মীয়জীবনের অবনতিও অনিবার্য। দেবতার উদ্দেশ্যের নিবেদিত ভোগকে প্রসাদ বলে খেলে সার্বিক কল্যাণ হয়। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে (শ্রাদ্ধ) নিবেদিত ভোগকে বলে প্রেতের ভোগ। প্রেতাত্মার দৃষ্টি পড়ে খাদ্যে। এই খাদ্যগ্রহণে দেহ রোগগ্রস্ত ও মনের শুদ্ধতা নষ্ট হয়। অশান্তি বাড়ে। বিবাহ অনুষ্ঠানের ভোগকে কামভোগ বলে। খাবি না কখনও। এতে মনে কামচিন্তা ও ভোগবাসনা বাড়ে।
মনে মনে ভাবছি, নিজে সংসারী হলেন না অথচ সংসারীদের সুখের জন্য কত কথাই জানেন সাধুবাবা! আর সংসারে থেকে সাংসারিক সুখলাভের জন্য কোনও খবরই রাখি না আমরা। এবার বললেন,
– পরের ঘরে খাওয়া আর পরের বিছানায় শোওয়া ভাল না। সুযোগ পেলেও অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে কখনও রমণ করবি না। অন্যের গা ছুঁয়ে কথা বলা, কয়েকজন একসঙ্গে বসে এক পাত্রে খাওয়া, এক আসনে (কাঠের আসন ছাড়া) কয়েকজন বসা, খুব কাছাকাছি কারও সঙ্গে বসে কথা বলা, এসবগুলো পরিত্যাগ করবি। একেবারে নিশ্চিত জানবি অন্যের পাপ দ্রুত সংক্রামিত হয় এসব কাজে।
এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর মুখ খুললাম,
– বাবা, আমরা সংসারী মানুষ। আপনার উপদেশ মতো কিছু কাজ করা সম্ভব। কিন্তু সংসারে থেকে সব কিছু এড়িয়ে চলা কি সম্ভব?
মাথা নাড়িয়ে স্বীকারোক্তি করেও বললেন,
– হ্যাঁ বেটা, একটু অসুবিধে হবে বটে তবে সচেষ্ট হলে এগুলো সবই সম্ভব হত। আসলে কি জানিস, এসব বিষয়গুলো অনেকের জানা নেই। জানলেও মেনে চলে না, ধৈর্যেরও বড় অভাব। ফলে সংসারীরা কোনও না কোনওভাবে ভুগছে, ভুগবেও।
একথার কোনও উত্তর দিলাম না। প্রশ্নও করলাম না। তিনি বলে চললেন,
– পূর্বজন্মের পুণ্যফল নষ্ট হয় যদি ঝাঁটার ধুলো, কুলোর বাতাস আর চুলধোয়া জল গায়ে লাগে। মঙ্গল হবে গরুর গা ঝাড়া আর ধানের ধুলো গায়ে লাগলে। দীক্ষিত ব্যক্তি জপের আসনে বসে কাশলে, হাঁচি দিলে, হাই তুললে অথবা বায়ুত্যাগ করলে উপাস্য দেবতা ক্ষুব্ধ হন। তাই জপের সময় এর কোনওটা হলে ডানহাত দিয়ে ডানকান স্পর্শ করলে দোষ খণ্ডন হয়।
এবার একটা অদ্ভুত কথা বললেন সাধুবাবা,
– সংসারে আছিস। কিন্তু কোনও শিশুর বা কারও নাম কোনও দেবদেবীর নামে রাখবি না।
কথা শুনে উপস্থিত সকলে একে অপরের মুখ চাওয়া চাইয়ি করলাম। কোনও দেবদেবীর নামে কারও নাম রাখা চলবে না, বলে কি সাধুবাবা! জানতে চাইলাম,
– কেন বাবা, দেবদেবীর নাম রাখা তো ভালই। তাতে দোষটা কোথায়?
অনেকক্ষণ একভাবে বসে থাকার পর এবার বসলেন একটু নড়েচড়ে। তারপর বললেন,
– দেবদেবীর নাম ভাল, তবে সংসারীদের না রাখাই ভাল। কেন জানিস? নামের সঙ্গে নামী অভেদ। কি রকম ধর, একজনের নাম রাখলি লক্ষ্মী। কোনও কারণে মেয়েটি কোনও অন্যায় বা অপরাধ করল। এটা সংসারে থাকলে করতেই পারে। তখন লক্ষ্মী নামকে সম্বোধন করে কেউ কুবাক্য প্রয়োগ বা গালমন্দ করল। এটা করল মনুষ্যরূপী একটা দেহকে লক্ষ্য করে। আসলে কিন্তু শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে পরোক্ষে গিয়ে কুবাক্য আঘাত করে নামী অর্থাৎ দেবীকে। কারণ শব্দ ব্রহ্ম। মানুষ লক্ষ্য হলেও পরোক্ষে রুষ্ঠা হন দেবী। এতে মেয়েটির সংসারজীবনের শান্তি নষ্ট হয়।
এখন সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– একটু লক্ষ্য করলেই তোরা দেখতে পাবি, দেবদেবীর নামের ছেলে বা মেয়েরা একটাও সংসারজীবনে শান্তিতে নেই। দেবদেবীর নাম রাখায় আপত্তি নেই। তবে নামের উপর কোনও আঘাত না হলেই ভাল। তাতে কল্যাণ হয় কিন্তু সংসারে থাকলে তা হওয়ার উপায় নেই।
মুখে একটু হাসির ভাব নিয়ে বললেন,
– অনেকেরই অভ্যাস আছে কোনও শুভ কাজ করার আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলে বেড়ানো। তা করবি না। শুভ বা ভাল কাজের বিষয় যত গোপন রাখবি, তার সিদ্ধি তত তাড়াতাড়ি। কাজ হওয়ার আগে বলে বেড়ালে সেই কাজে বিঘ্ন নইলে বিলম্ব ঘটে। আবার অনেক সময় সে কাজ পণ্ডই হয়ে যায়।
সাধুবাবা না থেমে বললেন,
– দেবদেবীর স্বপ্ন তো অনেকেই দেখে থাকিস। বলবি না কাউকে। স্বপ্নের সুফল নষ্ট হয়। যেকোনও খারাপ স্বপ্ন দেখলে সবাইকে ডেকে বলে দিতে হয়। তাতে দুঃস্বপ্নের কুফল নষ্ট হয়ে যায়। আর সাধনভজন জীবনের কথা, অলৌকিক দর্শন, কোনও ঈশ্বরীয় অনুভূতির কথা বলতে নেই কাউকে। এমনকি স্ত্রীরও উচিত নয় স্বামীকে বলা। এতে ভগবানের কৃপা নষ্ট হয়। বলে দিলে ওগুলো ধীরে ধীরে সব বন্ধ হয়ে যায়।
মোহিত হয়ে শুনতে লাগলাম সাধুবাবার কথা। শুনছে এখানে উপস্থিত ওড়িশাবাসীরাও। কারও মুখে একটা কথাও নেই। একেবারে স্থির হয়ে বসে আছে সকলে। সাধুবাবা বললেন,
– কোনও খাবার বিছানায় বসে খাবি না। এতে রোগব্যাধিকে আহ্বান করা হয়। আসনের উপর খাবার রেখে অথবা হাতের মধ্যে খাবার বেশি করে নিয়ে তা ধীরে ধীরে খেতে নেই। এতে লক্ষ্মী চঞ্চলা হয়। স্বামী–স্ত্রী একসঙ্গে বসে আহার করবি না। এতে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও সংসারে সারাটা জীবন শান্তিটা থাকবে না।
এবার কিছু উপদেশমূলক কথা বললেন,
– যতই ভোগ করিস না কেন, এর তৃষ্ণা কখনও মেটে না। কামনাও নিঃশেষ হয় না। ভোগবাসনা নিবৃত্তি হয় সংযমে। মানসিক শান্তির উৎসই হল সংযম। কারও মনে আঘাত দিবি না। সংসারে সব সময় অপমান সহ্য করতে অভ্যাস করবি। এগুলো সব অভ্যাস যোগ। সামান্য চেষ্টাতেই সফল হওয়া যায়। এই যোগ রপ্ত করতে পারলে মনে শান্তি পাবি।
অত্যন্ত জোর দিয়ে বললেন,
– অধর্মের পথে বেটা প্রথম অবস্থায় ধন সম্পদ নাম যশ খ্যাতি সব, সব বাড়ে। সংসার ভরে ওঠে। নিজে অন্যায় করেও জয়ী হয়। কিন্তু নিশ্চিত জানবি, এসব একেবারেই সাময়িক। ভগবানের কাছে এর কোনও ক্ষমা নেই। হঠাৎ একদিন তার জীবনে দুর্যোগ আসবেই আসবে। সমূলে ধ্বংস হবেই হবে। এর অন্যথা হবার নয়। একটা কথা মনে রাখিস তোরা, ভগবানের অপার করুণা থাকলে তবেই মানুষ হাসতে পারে প্রাণ খুলে, পারে নিশ্চিন্তে ঘুমতে। তাঁর এই কৃপাটুকু সংসারে থেকে সহজেই পেয়ে যাবি যদি অধর্ম অসৎপথের আশ্রয় না নিস।
একটা রোগের জন্য ওষুধ জানতে চাইলাম,
– বাবা, আমার পরিচিত দুজনকে জানি, যারা বহুদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছে মৃগীরোগে। আপনার কি এ রোগের কোনও ওষুধ জানা আছে?
কথাটা শোনামাত্রই বললেন,
– হাঁ বেটা, এই রোগের ওষুধ আছে। শনি অথবা মঙ্গলবারে সকালে স্নান করার আগে, নিঃশ্বাস বন্ধ করে একটানে কৃষ্ণতুলসীর গাছ তুলে শিকড়টা ডানহাতে কালো কার দিয়ে ধারণ করলে, যতদিনের মৃগীরোগ হোক না কেন – আরোগ্য হবে। হিস্টিরিয়া হলে কিন্তু ভাল হবে না। স্নান করার পর ধারণ করবে। এতে আর কোনও নিয়ম নেই।
আরও অনেক, অনেক কথাই বলেছিলেন সংসারীদের কল্যাণের জন্যে। পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে ভেবে আর এগোলাম না। এসব কথার পর জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, এটা করলে ভাল, ওটা করলে ভাল নয়, এমন অনেক কথাই তো বললেন। প্রায় কথারই তো কোনও কারণ বা ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না, কেন এটা হবে? যেমন ধরুন ঘি দিয়ে প্রতিদিন ভাত খেলে ধীরে ধীরে অভাব চলে যাবে, এটা কেমন করে সম্ভব? মন তো এসব কথা মেনে নিতে চায় না। এর ব্যাখ্যা কি, কারণটাই বা কি?
উত্তরে সাধুবাবা বললেন,
– একটা ডাবগাছে অনেক ডাব হয়ে আছে। গাছের তলায় বসে আছে একটা শিশু তার বাবার সঙ্গে। শিশু কখনও ডাব দেখেনি। বাবার কাছে প্রথম শুনল ডাব এমনই একটা ফল, যার মধ্যে শাঁস আর মিষ্ট জল আছে। শিশুর বিশ্বাস হবে না এককথায়। তার মনে হবে, এটা কি করে সম্ভব? বাবা কিন্তু জানে এটাই সত্য। কারণ সে জল ও শাঁস দুটোই খেয়েছে। বাবার পক্ষে এটা জানা সম্ভব হয়েছে গাঁছি ডাব পেড়ে দিয়েছিল বলে। তবে বাবা কিন্তু এটা জানে না ডাবের ভিতরে শাঁস আর জল সৃষ্টি হয় কেমন করে?
বেটা, প্রাচীন ভারতের ঋষিরা হলেন গাঁছি। তাঁরা ডাব পেড়ে দিয়েছেন, যাঁরা খেয়েছেন তাঁদের মুখ থেকে পরম্পরা চলে আসছে। পরম্পরাই হল বাবা সত্যতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ। না খেলে জানবি কেমন করে ওর ভিতরে শাঁস আর জলের কথা। আমরা তো শিশু। আমিও জানি না, তুইও জানিস না ডাবের ভিতরে শাঁস জল সৃষ্টি হচ্ছে কেমন করে! এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোনও প্রশ্ন নেই। ডাবে শাঁস জল হচ্ছে, এটাই চিরন্তন সত্য।
অনেক কথাই শুনলাম সংসারীদের বিষয়ে। সাধুবাবা চুপ করে বসে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। বিরক্ত করলাম না। বসে রইলাম। আর সকলে নড়ছে না কেউই। কথাও বলছে না। সাধুবাবাই বললেন,
– এবার তোরা যা। আমি একটু বিশ্রাম করি।
দুপুরে খাওয়া হয়নি আমার। যখন সাধুবাবার কাছে বসেছি, তখন বেলা প্রায় দশটা। এখন ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে বারোটা। যারা বসেছিলেন তারা সকলে একে একে উঠে পড়লেন প্রণাম করে। এক ভদ্রমহিলার ছেঁড়া আঁচলে বাঁধা ঠোঙায় ছিল খানচারেক রুটি। চিনিও ছিল একটু। রাখলেন সাধুবাবার পায়ের কাছে। বার বার অনুরোধ করলেন খাওয়ার জন্য। খাবেন কথা দিলেন সাধুবাবা। খুব খুশি হয়ে চলে গেলেন তিনি। তবে প্রত্যেকেই ‘পরে আবার আসব’ বলে গেলেন। সকলে চলে গেলেও আমি কিন্তু গেলাম না। খিদেও পেয়েছে খুব। ভাবলাম, খেতে গেলে সাধুবাবা যদি চলে যান, উদ্দেশ্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে আমার। তাই বসে রইলাম। আমাকে উঠতে না দেখে বললেন,
– কি রে বেটা, তুই গেলি না? বেলা যে অনেক হল। কিছু খাবি না, খিদে পায়নি তোর?
নিঃসংকোচেই বললাম,
– হ্যাঁ বাবা, খিদে পেয়েছে তবে দেরি আছে, একটু পরে খাব। কিছু কথা আছে আপনার সঙ্গে।
একটু ঝুঁকে পড়ে দুটো রুটি আমার হাতে দিয়ে বললেন,
– লে বেটা, খা লে।
আমিও বললাম,
– আপনিও খান বাবা।
সাধুবাবা নিজে তুলে নিলেন দুটো রুটি। খাওয়া শুরু করলেন কোনও কথা না বলে, আমিও। খাওয়া শেষ হলে কাছের কল থেকে জল খেয়ে এলাম। সাধুবাবাকে বললাম জলের কথা। ‘না’ করলেন ঘাড় নেড়ে। মিনিট পনেরো বিশ্রামের পর বললেন,
– তোর কি কথা আছে বলছিলি?
মুখে হাসি হাসি ভাব রেখে বললাম,
– একটু আগেই তো বললেন, সকালবেলায় প্রতিদিন স্নান করলে অলক্ষ্মীর দৃষ্টি পড়ে না। তা আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে বহুকাল স্নান তো দূরের কথা জলের ধারেও যাননি। আপনার উপরে কি লক্ষ্মীর দৃষ্টি আছে?
কথাটা শুনে হাসতে হাসতে বললেন,
– আমি তো বেটা সাধু। আমার না আছে ঘরদোর, না আছে সংসার। আমার লক্ষ্মীও নেই, অলক্ষ্মীও নেই। কোনওটার দরকারও নেই। সাধুরা কখনও লক্ষ্মীর উপাসনা করে না। গুরুর উপর ছেড়ে দিয়ে পড়ে থাকলে লক্ষ্মী আপনিই আসে। দয়াও করে। এতেই আজকের দিনটা চলে যাবে আমার।
লেখক- শিবশংকর ভারতী
ভারতের সাধক ও সাধিকা
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নূতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নূতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।
ভারতের সাধক ও সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত
প্রণয় সেন
প্রণয়
0 comments :
Post a Comment