স্বামীজির শেষদিন

স্বামীজি বলতেন, ‘শরীরটা কিছু নয়, কিন্তু এই শরীরের দ্বারাই তাঁকে লাভ করতে হবে।’ কর্মই ছিল তাঁর ঈশ্বরলাভের পথ। আর কর্মকাণ্ডের বারিধারায় মহাবিশ্বকে সজল করে আচমকা সেই শরীরই ত্যাগ করেছিলেন তিনি। ৪ জুলাই, ১৯০২... ফিরে দেখা স্বামী বিবেকানন্দের শেষের সেদিন।


মহামানবদের মহাপ্রয়াণ কাহিনী বহুযুগ ধরেই ভক্তগণকে উৎসুক করেছে। বুদ্ধ, শঙ্করাচার্য, যিশু, হজরত মহম্মদ, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী—কেউ এর থেকে বাদ পড়েননি।
১৫ আগস্ট (১৮৮৬), ৪ জুলাই (১৯০২), বাইশে শ্রাবণ বহু বাঙালির কাছে আজও বিশেষ বেদনার দিন, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামীজি ও কবিগুরুর তিরোভাব আমাদের বড় কষ্ট দেয়, আমরা জানতে চাই শেষের সেই দিনে কী এমন হয়েছিল যে, মৃত্যুঞ্জয়ী মহাজনদের বিদায়কাল অবশ্যম্ভাবী হল। ক্যান্সার রোগাক্রান্ত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছিল এবং কাশীপুর উদ্যানবাটীতে আগস্টের সেই অশুভ রাত্রে ভক্তজনের চোখের সামনে কী ঘটেছিল, তা তাঁর অন্ত্যলীলাগ্রন্থে গভীর যত্ন ও ধৈর্যসহকারে সংগৃহীত হয়েছে এক বিদগ্ধ সন্ন্যাসীর লেখনীতে। বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দর মহাপ্রয়াণ (৪ জুলাই ১৯০২) ছিল নিতান্তই আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত। কিন্তু এই মহাপ্রয়াণ সম্পর্কে এতদিন পরেও আমরা আর কতটুকু জানি?
আরও দুঃখের কথা আছে পরবর্তী প্রজন্মের মানুষদের কাছে। কোথায় আছে স্বামীজির বিদায়দিনের ছবি? তাঁরা সবিস্ময়ে স্মরণ করেন ১৮৮৬ সালে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে অনন্তশয়নে শায়িত শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে স্বামীজি ও ভক্তগণের দু’টি ঐতিহাসিক ছবি—যা তোলা হয়েছিল ঠাকুরের চিকিৎসক ডাঃ মহেন্দ্রনাথ সরকারের অর্থ সাহায্যে।
এখন প্রশ্ন অনেক। স্বামীজির ডেথ সার্টিফিকেট কোথায়? এমন জগদ্বিখ্যাত মানুষের শেষ ছবি কি সত্যিই তোলা হয়নি? স্বামী ব্রহ্মানন্দ কি সত্যিই ফোটোগ্রাফির বিরোধী ছিলেন? কোনও তাড়াহুড়ো তো ছিল না, পরের দিন অপরাহ্নের আগে তো স্বামীজির নশ্বর দেহ বেলুড়ের চিতাগ্নিতে দেওয়া হয়নি।
নানা সন্দেহের উত্তর খুঁজে পাওয়ার শ্রেষ্ঠ স্থান স্বামী গম্ভীরানন্দের যুগনায়ক বিবেকানন্দ। তিনি একজন তরুণ সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করছিলেন, আমি যদি স্বামীজির জীবনী লিখি, লোকে পড়বে? শুরু হল তাঁর সাধনা এবং দু’বছরের মধ্যে প্রায় দু’হাজার পৃষ্ঠা লিখে ফেললেন। তিন খণ্ডের তিনটি নাম—প্রস্তুতি, প্রচার ও প্রবর্তন। শেষ খণ্ডের শেষেই রয়েছে ‘মহাসমাধি’ পর্ব। গম্ভীর মহারাজ পরবর্তী সময়ে মঠ মিশনের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। স্বামীজির তিরোধানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং পাঠযোগ্য বিবরণ ‘যুগ নায়ক বিবেকানন্দ’তেই আছে। সেই লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিতেই হবে। কিন্তু তার আগে স্বামী অশেষানন্দর (১৮৯৯-১৯৯৬) ডায়েরি থেকে কিছু উদ্ধৃতি। স্বামী অখণ্ডানন্দ তাঁকে একবার বলেছিলেন, স্বামীজি প্রায়ই বলতেন, ‘আমার বাপ অল্পায়ু ছিলেন, আমিও বেশিদিন বাঁচব না।’ বাগবাজার পোলের ধারে দাঁড়িয়ে স্বামীজির কথাবার্তা—‘বীরের মতো মরব। যে কাছে থাকবে সেও তো জানবে না।’
গম্ভীর মহারাজ লিখেছেন, ৪ জুলাই মহাপ্রয়াণের সন্ধ্যায় বেলুড় মঠে স্বামী ব্রহ্মানন্দ বা স্বামী সারদানন্দ কেউ ছিলেন না, দুঃসংবাদ পেয়ে তাঁরা অবশ্য দু’জনেই কলকাতা থেকে ছুটে এসে হাল ধরেছিলেন। স্বামী অখণ্ডানন্দ, যাঁর ডাকনাম গঙ্গাধর, একটি বোমা ফাটিয়েছেন। স্বামী অশেষানন্দকে তিনি বলেছিলেন, রাখাল মহারাজ ও শরৎ মহারাজকে স্বামীজি নিজেই কোনও কাজের অছিলায় কলকাতার বলরাম মন্দিরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দু’তিনদিনের জন্য।
ঠাকুরের দাহকার্যের সময় স্বামী সারদানন্দের উক্তিও গঙ্গাধর মহারাজ ভোলেননি। স্বামী অখণ্ডানন্দ পরবর্তীকালে অশেষানন্দকে বলেছিলেন ‘কাশীপুরের ঠাকুরের শরীর দাহ করার সময় সারদানন্দকে স্বামীজি দেখালেন, ওই দেখ, ব্রহ্মারন্ধ্র ফেটে যোগীর মৃত্যু। মাথায় রক্ত। সূক্ষ্ম প্রাণ কি না, মাথার হাড় ফেটে বেরিয়ে যায়, বাইরে না দেখা গেলেও। এই প্রসঙ্গে সারদানন্দের মন্তব্য 
‘স্বামীজির সম্বন্ধে জানি না—মনে নেই।’
স্বামীজি নাকি বয়োবৃদ্ধ দীনু মহারাজকে তাঁর জিনিসপত্র সংরক্ষণ করতে বলে শুনিয়ে দিয়েছিলেন—‘এগজিবিশন হবে। আমার একটি চুলের দাম হবে লাখ টাকা।’
পরিব্রাজক জীবনে নানা অত্যাচার সহ্য করে স্বামীজি বেশ ভালোই ছিলেন আহারে এবং অনাহারে। প্রথম উদ্বোগজনক বড়সড় রোগের উল্লেখ রয়েছে মহেন্দ্রনাথ দত্তের লন্ডনে বিবেকানন্দ বইতে। নিজের ভাই এবং অনুরাগী মিস্টার ফক্সের সামনে তাঁর প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়, মাইল্ড অ্যাটাক, কিন্তু লক্ষণীয়। তাঁর দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাক ইজিপ্টে, মাদাম কালভের অতিথি হয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময়।
এই ‘অ্যানাদার হার্ট অ্যাটাক’ সম্বন্ধে আজও অনেক ধোঁয়াশা। ভূপেন্দ্র-অনুরাগী রঞ্জিত সাহার মুখে শুনেছি, ওই সময়ে স্বামীজিকে হাসপাতালের ভর্তি হতে হয়েছিল কায়রোতে। ছোটখাট অস্ত্রোপচারও নাকি হয়, এ বিষয়ে কোথাও তেমন উল্লেখ নেই। তবে উদ্বিগ্ন স্বামীজি যে পরিকল্পিত ট্যুরের মাঝপথে দেশে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে মাদাম কালভেকে উদ্বিগ্ন করে তোলেন, তা সবারই জানা। আন্দাজ হয়, দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাকের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যথাশীঘ্র গুরুভাইদের মধ্যে ফিরতে চেয়েছিলেন এবং সেইজন্য প্রায় বিনা নোটিসে অকস্মাৎ বোম্বাই মেল থেকে নেমে একদিন সন্ধ্যাবেলায় বেলুড়ে পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে খিচুড়ি খেতে বসে সকলকে অবাক করে দিয়েছিলেন।
বিবেকানন্দ-অনুসন্ধানে আমার প্রথম বই ‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ লিখতে গিয়ে স্বামীজির স্বাস্থ্য সম্বন্ধে একটা পরিচ্ছেদ লেখার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। স্বামীজির চিঠিপত্র থেকে এক-একটি রোগের খবর আহরণ করে যে তালিকা তৈরি করেছিলাম সেখানে রোগের সংখ্যা ৩১টি। বিশ্ববিজয় করে কলকাতায় ফিরে স্বামীজির ইউরিন সুগার কত হয়েছিল, স্বামী অখণ্ডানন্দ তা জানতেন এবং লিখেও গিয়েছেন।
তাহলে অকালমৃত্যুর পক্ষে ডায়াবেটিসই কি যথেষ্ট? 
শঙ্করীপ্রসাদ বসু বলতেন, ইয়েস পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত ডায়াবেটিক, তাঁর অকাল মৃত্যু হয়েছিল ৫২ বছর বয়সে। তা না হয় ইয়েস, কিন্তু হোয়াট অ্যাবাউট দুই ভ্রাতা? মহেন্দ্রনাথ দত্ত ও ভূপেন্দ্রনাথ তো পারিবারিক ধারা ডোন্ট কেয়ার করে বেঁচেছিলেন ৮৮ ও ৮১ বয়স পর্যন্ত। তাহলে? স্বামীজির বিভিন্ন ছবি দেখতে দেখতে একজন ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন, ধৈর্য ধরে একটু সাবধানে দেখলে আপনি অনেক পয়েন্ট পেয়ে যাবেন, মাঝে মাঝে স্বামীজি ওয়েট গেন করছেন, কখনও আবার রোগা, আজকালের ডাক্তারদের হাতে পড়লে শরীরটাকে শাসনে রেখে দীর্ঘজীবী হয়ে তিনি মানুষের মঙ্গল করতে পারতেন।
অল্প সময়ের মধ্যে অনেক অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে গিয়ে স্বামীজি বোধহয় নিজের শেষটা নিজেই ডেকে এনেছিলেন। নিদ্রাহীনতা তাঁর দীর্ঘকালের সঙ্গী। ধীরামাতাকে (সারা বুল) তিনি দুঃখ করছেন, ‘এ বছরে আমি একদিনও ভালোভাবে ঘুমোইনি।’
স্বামীজিকে সারাজীবন বিব্রত করেছে পেটের রোগ অথবা ডিসপেপসিয়া। এই রোগের তাড়নায় পরিব্রাজক অবস্থায় তাঁকে ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাসে ভ্রমণ করতে বাধ্য করেছে, এই পেটের ভয়েই তিনি প্রথমবার বিদেশ যাত্রায় ডেকের যাত্রী হতে পারেননি, খেতড়ির মহারাজা যথা সময়ে তাঁকে জাহাজের উঁচু ক্লাসের টিকিট কিনে দিয়েছিলেন, এবং খেতড়িকে জাহাজ থেকে লেখা চিঠিতে বারবার বাথরুম যাওয়া সম্পর্কে তাঁর স্বীকারোক্তি রয়েছে।
স্বামীজি নামক বিমানের নীচে নামা কবে থেকে শুরু হল? তাহলে বলতে হয় (ডিসেম্বর ১৮৯৮) দেওঘরে গিয়ে হাঁপানির প্রবল আক্রমণে স্বামীজির জীবন সঙ্কটাপন্ন। একটা উঁচু তাকিয়ার উপর ভর দিয়ে বসে তিনি মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতেন। দেওঘর থেকে ফিরে এসে স্বামীজি নিজেই বলতেন, দু’বছরের শারীরিক কষ্ট আমার বিশ বছরের আয়ু হরণ করেছে।’
এরপরেই স্বামীজির শেষবারের বিদেশ যাত্রা। দেখা যাচ্ছে, সুগার ছাড়াও আছে অ্যালবুমিনের দৌরাত্ম্য। তারপর অনেক ঘাটের জল খেয়ে ভারতে ফিরে আসা। মিশর থেকে জাহাজে চড়েছিলেন ২৬ নভেম্বর ১৯০০। দেওয়াল টপকে বেলুড় মঠে প্রবেশ রবিবার ৯ ডিসেম্বর, ১৯০০। একই সময়ে অনুরাগী জন ফক্সকে লেখা—‘আমার শরীর দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে। মাকে এবং সংসারকে দেখার ভার নেওয়ার জন্য মহিমকে তৈরি হতে হবে। আমি যে কোনও সময়ে চলে যেতে পারি’। প্যারিস থেকে প্রিয় গুরুভাই হরি মহারাজকে তিনি লিখেছিলেন। ‘আমার কাজ আমি করে দিয়েছি বস। গুরু মহারাজের কাছে ঋণী ছিলাম—প্রাণ বার করে আমি শোধ দিয়েছি।’
১৯০৯ সালের মার্চ মাসে মাকে নিয়ে ঢাকা চললেন স্বামীজি। গৌহাটিতে হাঁপানি বাড়ে এবং শিলংয়ে অবস্থা এমন খারাপ হয় যে, কতকগুলো বালিশ একত্র করে বুকে উপর ঠেসে ধরতেন। অ্যালবুমিন বেড়ে শরীর দ্বিগুণ ফুলে গিয়েছিল।
পরের বছর বারাণসী থেকে ফিরে আবার আশ্রয় নেওয়া বেলুড় মঠে (সম্ভবত ৭ মার্চ ১৯০২)। শেষপর্বে শরীর সম্বন্ধে নিয়মিত চিঠি লিখেছেন সিস্টার ক্রিস্টিনকে, তাঁর বক্তব্য—হাঁপানি এবার পোষ মানছে, ডায়াবেটিস ও ব্রাইটস ডিজিজ একেবারেই উধাও।
দ্বিতীয় অসুখটি কিডনি সংক্রান্ত। দারুণ গ্রীষ্মে ঘামাচির আক্রমণ। সেই সঙ্গে তিক্ত মেজাজ।
নভেম্বরে দু’টি খারাপ খবর—ডান চোখটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এক সময় তিনি সর্দিতে বিছানাবন্দি। এবং হাঁপানির পুনরাগমন। ‘আমি কিছুই প্রায় দেখতে পাচ্ছি না,’ জানাচ্ছেন স্বামীজি স্বয়ং।
শেষ কয়েক মাসে চিন্তার কারণ শোথ ও ড্রপসি। গুরুভাইরা একবার ছুটছেন কবিরাজ মহানন্দ সেনগুপ্তর কাছে, আর একবার সায়েব ডাক্তার সন্ডার্সের কাছে।
এরই মধ্যে হাওয়া বদলাবার জন্য আত্মীয়া ও শিষ্যা মৃণালিনী বসুর কাছে বড় জাগুলিয়ায়—প্রথমে ট্রেনে, পরে গোরুর গাড়িতে সাত মাইল। এমন যাত্রার পরেও ড্রপসি ফিরে এল না, পা ফুলল না।
শেষ পর্বে স্বামীজির রোগের তালিকায় নতুন সংযোজন উদরী, অর্থাৎ পেটে জল হওয়া।
স্বামী অখণ্ডানন্দ জানাচ্ছেন, ভোরবেলায় স্বামীজির ঘরে আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছি, ভেবেছি স্বামীজি ঘুমোচ্ছেন, কিন্তু তিনি জেগে আছেন, তাঁর কাছ থেকে উত্তর এল গানের সুরে—‘নকিং নকিং হু ইজ দেয়ার? ওয়েটিং ওয়েটিং ও ব্রাদার ডিয়ার।’
একবার ভোর চারটে না হতেই গঙ্গা মহারাজকে বললেন সবাইকে তুলে দিতে। গঙ্গা মহারাজ দ্বিধা করছিলেন, স্বামীজি এবং বললেন, কি দুটোর সময়ে শুয়েছে বলে ছ’টার সময়ে উঠতে হবে... আমি থাকতেই এই! ঘুমোবার জন্য মঠ হল নাকি?

৪ জুলাই মহানির্বাণের দিনেও স্বামীজি দিবানিদ্রার নিন্দা করেছিলেন, বললেন, ‘তোরা ঘুমোবি বলে মঠ হল নাকি?’

জর্জরিত শরীরে বন্ধু ব্রহ্মানন্দকেও তিনি যা তা বলে চোখের জল ফেলেছিলেন। তারপর লজ্জা পেয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন—‘আমি কি করবো, আমার শরীরটা চব্বিশ ঘণ্টাই জ্বলছে।’
শরীর নিয়ে শেষপর্বে স্বামীজির যথেষ্টই হতাশা। দেহত্যাগের এক সপ্তাহ আগে অসীম বসু জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছেন? স্বামীজি বললেন, তুমিও যেমন। ডাক্তারবদ্যিতে তো অনেক কথাই বলে। কিন্তু আমার মৃত্যুরোগ। তারা কী করবে?
আরও একটা খবর, জুন মাসের শেষের দিকে কবিরাজি চিকিৎসার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করে বরানগরের খ্যাতনামা ডাক্তার মহেন্দ্রনাথ মজুমদারকে ডাকা হয়।

এবার এসে গিয়েছে শেষের সেই দিন, শুক্রবার ৪ জুলাই ১৯০২। এই দিন খুব সকালে উঠে স্বামীজি মন্দিরে গেলেন উপাসনার জন্য।

ব্রেকফাস্টের সময় দুধ ও ফল খেলেন এবং সকলের সঙ্গে হাসিঠাট্টা হল, সেদিন গঙ্গার ইলিশ কেনা হল (সে বছরের প্রথম) এবং তার দাম নিয়ে স্বামী প্রেমানন্দের সঙ্গে অনেক রহস্য হল, একজন বাঙালকে বললেন, তোরা নতুন ইলিশ পেলে নাকি পুজো করিস? কী দিয়ে পুজো করতে হয় কর।
তারপর মর্নিং ওয়াক।

সকাল ৮.৩০: স্বামী প্রেমানন্দকে বললেন, আমার আসন ঠাকুরের শয়নঘরে করে, চারদিকের দরজা বন্ধ করে দে। স্বামী অখণ্ডানন্দের মতে প্রেমানন্দকেও তিনি কাছে থাকতে দিলেন না, ওইখানে তাঁর ধ্যান শুরু।

সকাল ১১টা: ধ্যানভঙ্গের পরে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে স্বামীজি নিজের হাতে ঠাকুরের বিছানা ঝেড়ে দিলেন।

সকাল ১১.৩০: মনের আনন্দে সকলের সঙ্গে একত্রে মধ্যাহ্নভোজন—ইলিশ মাছের ঝোল, ভাজা, অম্বল দিয়ে ভাত খেলেন। 
‘একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে, ঘটিবাটিগুলো ছেড়েছি অনেক কষ্টে।’

দুপুর ১২.৩০: মিনিট পনেরো ঘুমিয়ে স্বামী প্রেমানন্দকে স্বামীজি বললেন, সন্ন্যাসী হয়ে দিবানিদ্রা পাপ, চল পড়িগে।

বেলা ১.৩০: অন্য দিনের তুলনায় ঘণ্টা দেড়েক আগে লাইব্রেরি ঘরে সাধু-ব্রহ্মচারীদের ক্লাস নিলেন। পড়ালেন পাণিনী ব্যাকরণ।

বিকেল ৪টা: এক কাপ দুধ খেয়ে বাবুরাম মহারাজকে নিয়ে বেলুড় বাজার পর্যন্ত গেলেন। প্রায় দু’মাইল ভ্রমণ, ইদানীং এতটা হাঁটতেন না। ওই সময় বেদ এবং বেদবিদ্যালয় সম্বন্ধে অনেক কথা হয়।

বিকেল ৫টা: স্বামীজি মঠে ফিরলেন। তামাক খেয়ে শৌচকর্ম সেরে এসে বললেন, আজ শরীর যেমন সুস্থ, এমন অনেকদিন বোধ করি না।

সন্ধ্যা ৬.৩০: স্বামীজি এককাপ চা চাইলেন।

সন্ধ্যা ৭.০৫: সন্ধ্যা ঘণ্টা বাজতেই স্বামীজি নিজের ঘরে চলে গেলেন। সঙ্গে বাঙাল ব্রজেন্দ্র। নিজের ঘরে ধ্যান শুরু করার আগে সেবক ব্রজেন্দ্রকে বললেন, যতক্ষণ না ডাকি, অন্য ঘরে গিয়ে জপ-ধ্যান কর।

সন্ধ্যা ৭.৪৫: স্বামীজি এবার ব্রজেন্দ্রকে বললেন, গরম বোধ হচ্ছে, জানলা খুলে দাও। মেঝেতে শুয়ে পড়লেন, হাতে জপমালা। একটু পরে বললেন, আর বাতাস করতে হবে না। একটু পা টিপে দে।

রাত ৯.০০: এতক্ষণ তিনি চিৎ হয়ে শুয়েছিলেন, এবার বাঁ-পাশ ফিরলেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাঁর ডান হাত একটু কাঁপল। স্বামীজির কপালে ঘামের ফোঁটা। এবার শিশুর মতন কান্না।

রাত ৯.০২ থেকে ৯.১০: গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। মিনিট দুই পরে আবার গভীর দীর্ঘশ্বাস, একটু নড়ে উঠে মাথা বালিশ থেকে পড়ে গেল। চোখ স্থির, মুখে অপূর্ব জ্যোতি ও হাসি।

৯.২০: কিংকর্তব্যবিমূঢ় যোগেন এবার গিয়ে গোপালদাকে ডেকে আনলেন। এই গোপালই সর্বজন পরিচিত স্বামী অদ্বৈতানন্দ যাঁর নাম ঠাকুরের ডেথ রেজিস্টারে লিখিত আছে। সবাই এঁকে বুড়ো গোপাল বলে ডাকত। ১৯০১ সালে স্বামীজি তাঁকে মঠের ট্রাস্টি করেন।
ডাঃ মজুমদার থাকতেন নদীর ওপারে বরাহনগরে, তাঁকে ডেকে আনবার সিদ্ধান্ত হল, আর প্রেমানন্দ ও নিশ্চয়ানন্দ স্বামীজির সমাধি ভাঙাবার জন্য তাঁর কানে রামকৃষ্ণ নাম শোনাতে লাগলেন।

রাত ১০.৩০: বেলুড় মঠে এসে ডাক্তার মজুমদার দেখলেন, নাড়ি বন্ধ এবং কৃত্রিম উপায়ে হার্ট সচলের ব্যর্থ প্রচেষ্টা শুরু হল।

রাত ১২.০০: ডাক্তারের ঘোষণা স্বামীজি আর ইহলোকে নেই। তিনি ৪০ দেখলেন না, তাঁর মহামুক্তি ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিনে।

পরের দিন সকাল। ৫ জুলাই শনিবার দেখা গেল স্বামীজির চোখ দু’টি জবাফুলের মতন রক্তবর্ণ, নাকমুখ দিয়ে অল্প অল্প রক্ত বেরিয়েছে। ডাক্তার বিপিন ঘোষ বললেন সন্ন্যাস রোগে দেহত্যাগ। যদিও মহেন্দ্র ডাক্তার বলে গিয়েছেন হৃদক্রিয়া বন্ধ হওয়াই দেহাবসানের কারণ। স্বামীজির ডেথ সার্টিফিকেট কে দিয়েছিলেন এবং সেখানে কি লেখা আছে, তা সংগ্রহ করতে পারিনি।
আরও যা জানা যায়, গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী খবর পেলেন সকাল বেলায়। ভগ্নীপতিকে নিয়ে ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ বেলুড় মঠে এলেন, কিছুক্ষণ পরে কাঁদতে কাঁদতে এলেন জননী ভুবনেশ্বরী, তাঁর সঙ্গে দৌহিত্র ব্রজমোহন ঘোষ। 
সকাল সাতটাতেই নিবেদিতা এসে গিয়েছিলেন, তারপর নির্বাক হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাত-পাখায় স্বামীজিকে হাওয়া করেছিলেন।
শোকার্ত নরেন্দ্র জননীকে সন্ন্যাসীরা এক সময়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যা নিবেদিতাকে কিছুটা বিস্মিত করেছিল।
চিতাগ্নি প্রজ্জ্বলিত হতে একটু সময় লেগেছিল, কারণ বালি মিউনিসিপ্যালিটির অনুমতি প্রথমে আসছিল না, শোনা যায় স্বামী সারদানন্দের সঙ্গে মিউনিসিপ্যালিটির কয়েকবার দ্রুত পত্রবিনিময় হয়েছিল। এইসব চিঠি আজও প্রকাশিত হয়নি, আদৌ সেগুলো রক্ষিত হয়েছে কি না, তাও জানা যায় না। দাহকার্য শেষ হয় শনিবার সন্ধ্যা ছ’টায়।
আরও অনেক কথা জানা এবং অজানা অবস্থায় আজও ঐতিহাসিকদের অনুসন্ধানের জন্য পড়ে রয়েছে। 
আমরা শুধু জানি, স্বামী নিরঞ্জনানন্দ শোকার্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষকে বলেছিলেন, ‘নরেন চলে গেল।’ উত্তরে মহাকবি গিরিশের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘চলে যাননি, দেহত্যাগ করলেন।’

পুঃ: এতদিন পরেও দুটি বড় বড় প্রশ্ন—অন্তিম শয্যায় স্বামীজির কোনও ছবি কি কোথাও নেই? 

স্বামী ব্রহ্মানন্দ কেন ছবি তোলাতে আপত্তি করেছিলেন?

আরও বড় বিস্ময়—কলকাতার সংবাদপত্রের স্বামীজির আকস্মিক মহাপ্রয়াণ কেন তেমনভাবে ছাপা হয়নি? 

স্বামীজির সমাধিস্থলে ছোট্ট একটি মন্দির তৈরির কাজ কেন অর্থাভাবে আটকে গিয়েছিল? 

অনেক বছর পরে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় ২ জানুয়ারি ১৯২৪।

অচেনা অজানা বিবেকানন্দ— শংকর
যুগনায়ক বিবেকানন্দ— স্বামী গম্ভীরানন্দ
লেটারস অফ নিবেদিতা—১ম খণ্ড
       ভারতের সাধক ও সাধিকা


আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নূতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নূতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।

ভারতের সাধক ও সাধিকা
      পুণঃপ্রচারে বিনীত 
             প্রণয় সেন
                প্রণয়
Share on Google Plus

About Indian Monk - Pronay Sen

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.

0 comments :

Post a Comment