গুরু ও সদ্গুরু একই বস্তু, কারণ অসদ্গুরু বলিয়া কোন বস্তু নাই। তবে বুঝাইবার সুবিধার জন্য গুরু হইতে সদ্গুরু শব্দের বৈলক্ষণ্য দেখান হয়। যাঁহার কৃপায় পূর্ণ সত্যের রূপ প্রত্যক্ষ হয়—যে প্রত্যক্ষের পর আর কোন আবরণ থাকে না—তিনিই সদ্গুরু। যিনি আবরণের আংশিক নিবৃত্তিতে সহায়ক হন তাঁহাকে গুরু বলা হয়। যিনি আবরণ অংশতঃ নিবৃত্ত করিতে সাহায্য করিতে পারেন না। তাঁহাকে গুরু বলা যায় না। তান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে দীক্ষা ব্যাপারের যিনি অনুষ্ঠাতা তিনিই গুরু। প্রকৃত প্রস্তাবে গুরু একমাত্র ভগবান্, দ্বিতীয় কেহই নহে। কিন্তু জীব সাক্ষাৎভাবে তাঁহাকে ধরিতে পারে না। এই জন্য তিনি যোগ্য আচার্যের আধারে শিষ্য উদ্ধারের জন্য আত্মপ্রকাশ করিয়া থাকেন। আচার্যকেও এইজন্য গুরু বলা হয়। দুর্গা প্রতিমাতে যেমন মহাশক্তি জগদম্বার অধিষ্ঠান হয় বলিয়া ঐ প্রতিমাকেও দুর্গা বলা হয় তদ্রুপ যে দেহকে আশ্রয় করিয়া নিত্য গুরুশক্তি কার্য করিয়া থাকে সেই দেহকেও গুরু বলিয়া বর্ণনা করা হয়। ইহাই আচার্য দেহ। আচার্যের সহিত পরমেশ্বরের সাক্ষাৎ অথবা পরম্পরাগত যোগ স্থাপিত না হইলে আচার্য ভগবানের প্রতিনিধিরূপে গুরুকার্য করিতে সমর্থ হন না। আচার্য জীবোদ্ধার ব্যাপারে নিমিত্ত মাত্র। প্রকৃত গুরুরূপী ভগবানই যথার্থ কর্ত্তা। প্রশ্ন হইতে পারে, এইরূপ নিমিত্ত আশ্রয় না করিয়া সাক্ষাৎভাবে কি ভগবান্ অনুগ্রহ করিতে পারেন না? এর উত্তর নেই, নিশ্চয়ই পারেন। তবে সাধারণতঃ তাহা করেন না। তাঁহার অনুগ্রহ বিতরণ দুই প্রকার জানিতে হইবে—একটিকে সাধিষ্ঠান অনুগ্রহ বলে, অপরটিকে নিরধিষ্ঠান অনুগ্রহ বলে ভগবান্ স্বরূপতাঃ প্রকৃতি, মায়া বা মহামায়ার অতীত। সুতরাং তাঁহার স্বরূপ হইতে অনুগ্রহ প্রাপ্তি সকলের ভাগ্যে ঘটে না। যে সকল জীব প্রাকৃত বা মায়িক দেহে আবদ্ধ তাহারা ভগবৎ স্বরূপ হইতে নির্গত অনুগ্রহশক্তি ধারণ করিতে পারে না। যে সকল জীব বিবেক-জ্ঞানের প্রভাবে প্রকৃতি ও মায়া হইতে পৃথক হইতে পারিয়াছেন অথচ যাঁহাদের জীবত্ব বা পশুত্ব দিব্যজ্ঞান না পাওয়ার দরুণ এখনও নিবৃত্ত হয় নাই সেই সকল বিদেহ-কৈবল্য প্রাপ্ত আত্মার মধ্যে যাহাদের মল পরিপক্ক হইয়াছে তাহাদিগকে মলপাকের তারতম্য অনুসারে নবীন সৃষ্টির প্রাক্ক্ষণে ভগবান স্বয়ং অনুগ্রহ করিয়া থাকেন। ইহা নিরধিষ্ঠান দীক্ষা দানের দৃষ্টান্ত। এই স্থানে আচার্যের প্রয়োজন হয় না। কারণ ইহা সৃষ্টির পূর্বের অবস্থার কথা। সৃষ্টির অন্তর্গত জীব সাধারণতঃ আচার্য হইতেই দিব্যজ্ঞান প্রাপ্ত হইয়া থাকে। অবশ্য স্বাতন্ত্র্যময় পরমেশ্বরের পক্ষে সব সময় সবই সম্ভবপর হয়। আমরা সাধারণত যে আচার্যগুরুর কথা বলিয়া থাকি তাহার দেহ মনুষ্যস্তরের অন্তর্গত। কিন্তু সিদ্ধ ও দিব্য স্তরেও গুরু দেহ থাকিতে পারে এবং অনেকে ঐ প্রকার গুরু হইতে দীক্ষা প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।
গুরু খণ্ড হইলেও পরমতত্ত্বের সাক্ষাৎকার না করিয়া থাকিলে তাঁহাকে সদ্গুরু বলা যায় না। কিন্তু খণ্ডগুরুর প্রদত্ত জ্ঞানের মধ্যে পূর্ণতার অভাববশতঃ একটা ক্রমিক ভাব বা তারতম্য বিদ্যমান থাকে। তদনুসারে ইহা বলা হইয়া থাকে যে গুরু স্বয়ং যে স্তরে থাকেন শিষ্যকেও দীক্ষা দ্বারা সেই পর্যন্ত উঠাইয়া নিতে পারেন। গুরুর জ্ঞান যদি খণ্ড না হয় তাহা হইলে এই শঙ্কা উত্থিত হইতে পারে না।
শাস্ত্র অনুসারে দীক্ষা ও শক্তিপাতের মধ্যে সাধারণতঃ কিছু কিছু ভেদ প্রদর্শন করা হয়। কারণ শক্তিপাত হয় সাক্ষাৎ পরমেশ্বর হইতে—কারণ তিনি ভিন্ন অনুগ্রহ করিবার যোগ্যতা আর কাহারও নাই। সাপেক্ষ অনুগ্রহ নিম্নস্তর হইতেও হইতে পারে। কিন্তু পরম অনুগ্রহ করিবার যোগ্যতা একমাত্র ভগবানেরই আছে। পরম অনুগ্রহের ফলে শিবত্ব লাভ হয়। খণ্ড অনুগ্রহের ফলে নানা প্রকার উচ্চ অবস্থা লাভ হইতে পারে। যে জীবে শক্তিপাত হইয়াছে একমাত্র সেই জীবই দীক্ষা লাভের উপযুক্ত। আচার্য গুরু জ্ঞানী হইলে দৃষ্টিমাত্র বুঝিতে পারেন কাহারও শক্তিপাত হইয়াছে কিনা। যাহাতে শক্তিপাত হয় নাই এইরূপ জীবকে জ্ঞানীগুরু কখনই দীক্ষা দিতে অগ্রসর হন না। দীক্ষা ক্রিয়াশক্তির কার্য। মূলে ইহা পরিপূর্ণ জ্ঞান ও ক্রিয়ার অভিন্নতাময় চিৎশক্তির ব্যাপার। সৃষ্টির পূর্বে বিদেহ আত্মাকে যে ভগবান্ স্বয়ং দীক্ষা দেন সেখানে জ্ঞান-শক্তি ও ক্রিয়া-শক্তির পার্থক্য থাকে না, যদিও আধার-ভেদ অনুসারে সঞ্চারিত শক্তির মাত্রার তারতম্য থাকে। সৃষ্টির অভ্যন্তরে পূর্ণ জ্ঞান ও ক্রিয়ার অভিন্নতাময় চিৎশক্তির ব্যাপার। সৃষ্টির পূর্বে বিদেহী আত্মাকে যে ভগবান্ স্বয়ং দীক্ষা দেন সেখানে জ্ঞান-শক্তি ও ক্রিয়া-শক্তির পার্থক্য থাকে না, যদিও আধারভেদ অনুসারে সঞ্চারিত শক্তির মাত্রার তারতম্য থাকে সৃষ্টির অভ্যন্তরে দেহবিশিষ্ট জীবকে অনুগ্রহ করিতে হইলে ক্রিয়া-শক্তির ব্যাপারটি আচার্যকে অবলম্বন করিতে হয় বলিয়া শক্তিপাতের মূল ব্যাপারটি শুধু ভগবৎ সাপেক্ষ থাকে। শক্তিপাতের তাৎপর্য এই যে জীব-বিশেষ উঠাইয়া নিবার জন্য ভগবান্ ইচ্ছা করিয়াছেন, অর্থাৎ জীব-বিশেষের উপর ভগবানের করুণাদৃষ্টি রহিয়াছে। ভগবানের এই করুণাদৃষ্টির দিকে লক্ষ্য করিয়াই আচার্য দীক্ষা দানে অগ্রসর হন। দীক্ষার ফলে, জ্ঞান ও ক্রিয়া উভয় শক্তিরই সঞ্চার হয়। ক্রিয়া শক্তির মাত্রা থাকে আংশিক।
সাধারণতঃ পুরুষই গুরু হয়—স্ত্রী গুরু হইতে পারে না। যখন স্ত্রী শরীর দীক্ষা দান করে তখন বুঝিতে হইবে তাঁহার মধ্যে পুরুষ শরীর কাজ করিতেছে। শ্রীশ্রীসিদ্ধিমাতাকে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিয়াছিলেন তাঁহার মধ্যে নারায়ণ রহিয়াছেন, তিনি দীক্ষা দেন। স্ত্রী শরীর কিছু ন্যূনতা রহিয়াছে। ইহার ব্যতিক্রমও আছে শাস্ত্রে। যখন স্ত্রী শরীর ব্রহ্মজ্ঞান বা আত্মজ্ঞান লাভ করে তখন তাঁহার দীক্ষা দিবার অধিকার জন্মে কেননা আত্মা পুরুষ।
আলোচনাপ্রসঙ্গে বলিলেন দীক্ষার বিষয় নিয়ে একটা বড় কাজ করা যায়। দীক্ষার সময় গুরু কি দেখেন? কিছুক্ষণ পর উত্তরদান প্রসঙ্গে বলিলেন প্রত্যেক ব্যক্তির ‘অহং’— ‘অ’ হইতে ‘হ’ বর্ণমালা ৫০টি মাতৃকার দ্বারা গঠিত। কিন্তু সেই বর্ণমালার যে আদর্শ সংগঠন তাহা হইতে কিছু কম বেশী থাকে যেমন ‘চ’-এর ৫ থাকার কথা, হয়তো আছে ৯; আর ‘ছ’-এর ৬ থাকার কথা আছে ৪; যেমন যে বর্ণমালার যতটুকু প্রয়োজন সেই সামরস্যের প্রতিষ্ঠা করাই দীক্ষার উদ্দেশ্য।
সদ্গুরু আলিঙ্গনের সময় সেই সামরস্য স্থাপন করিয়া দেন। তারপর হয়তো সেই ব্যক্তির জাগতিক জীবনের আচার ব্যবহারে কোন পরিবর্তন আসে না। কিন্তু গুরু তাহাকে ভগবদ্ উন্মুখ করিয়া দেন। যদি তিনি সাধক হন তাহা হইলে সাধনার দ্বারা এই জীবনেই পরমবস্তু লাভ করিয়া জীবন্মুক্ত হইতে পারেন। নতুবা দেহরক্ষার পর তাঁহার মুক্তি অবশ্যম্ভাবী। এই সামরস্য স্থাপনের সময়ও বৈয়ক্তিক স্বাতন্ত্র্য থাকে। যেমন কবিরাজি চিকিৎসায় কবিরাজ রোগীর বায়ু, পিও, কাফের সামরস্য দেখেন। যদি সামরস্য না থাকে, সামরস্য আনিবার জন্য ঔষধ দিয়া থাকেন পূর্ণরূপে রোগ নিরাময়ের জন্য।
পূর্বের তিন জন্মের সংস্কার-সাপেক্ষ ভাবে পরিদর্শন করিয়া সাধন জীবনের ধারাটি আবিষ্কার করিতে হয়। সাধনা ষোল আনা পূর্ণ হইলে একই পরম লক্ষ্যে উপনীত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। যে মার্গে সাধকের অধিক পরিশ্রম হইয়া থাকে এবং তজ্জন্য সাধন সংস্কার অধিক বর্ত্তমান থাকে সেই মার্গই বর্ত্তমানে উক্ত সাধকের পক্ষ অবলম্বনীয়। তাহা হইলে পরিশ্রমের অনেকটা লাঘব হয় এবং পূর্ব জন্মের কৃত কর্ম বর্ত্তমান জন্মে ফলসিদ্ধির সহায়ক হয়।
কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে ইহা একটি স্থূল ব্যাপার মাত্র। গত তিন জন্ম তো দূরের কথা, ঐ প্রকার সহস্র জন্ম বিচার করিলেও প্রকৃত পথের সন্ধান পাওয়া যাইবে না। ঐ তিন জন্ম বস্তুতঃ এক জন্মেরই ত্রিবিধ বিলাস মাত্র। স্থূলদেহ ধারণই স্থূল জগতে অর্থাৎ ভৌতিক স্তরে প্রবেশে চিহ্নস্বরূপ। স্থূলদেহ সর্ব্বপ্রথম কখন গ্রহণ করা হইয়াছিল ইহার ইতিহাস কেহ বলিতে পারে না। স্থূলদেহ জাত হয় এবং মৃত হয়—এই প্রকার জন্ম-মৃত্যু যে কতবার হইয়া গিয়াছে তাহারও সন্ধান কেহ জানে না। কালের জগতে নামিয়া আসা জন্ম-মৃত্যুর অধীন হওয়া, কিন্তু এই স্থূলদেহে প্রবেশ কোথা হইতে হইয়াছে তাহা জানা আবশ্যক। যদি সেই সন্ধান পাওয়া যায় তাহা হইলে সেখান হইতে আরও ঊর্দ্ধে উঠিয়া সন্ধান নিতে হইবে যে মৌলিক আবরণ সর্বপ্রথম কোন সূত্রে শুদ্ধ চৈতন্যকে গ্রাস করিয়া থাকে।
শ্রীশ্রীগুরুদেব তাঁহার ‘‘প্রকৃতি তত্ত্বে’’ বলিয়াছেন—‘‘স্বভাবের ধারা ত্রিধা সৃষ্টি করা।’’ এই যে ত্রিবিধ সৃষ্টি ইহাই বস্তুতঃ আত্মার তিনটি জন্ম। এই তিনটি জন্মের বৃত্তান্ত নিপুণ-দৃষ্টিতে দেখিতে না পারিলে সেই মায়িক জগৎ হইতে পরম স্থানে পৌঁছিবার ধারাটি খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। পরম পথকে আবিষ্কার করাই দীক্ষার উদ্দেশ্য। এই তিন জন্মের মধ্য দিয়াই, অর্থাৎ এই ত্রিবিধ স্তর ভেদ করিয়াই, এই পথটি প্রসারিত রহিয়াছে। কোন সাধকের প্রকৃতি নির্ণয় করিতে হলে তাহার মায়িক দেহ, মহামায়িক দেহ এবং চিন্ময় দেহের প্রকৃতি অবগত হওয়া আবশ্যক।
বিশুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপতঃ নিরাকার ও নির্মল চিদবস্তু। যখন সৃষ্টি মুখে উহা কালের রাজ্যে আগত হয় তখন প্রকৃতির বিভিন্ন স্তর ভেদ করিয়া উহাকে আসিতে হয়।
গোপীনাথ কবিরাজের ‘সাধনা ও সিদ্ধি’
ভারতের সাধক ও সাধিকা
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নূতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নূতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।
ভারতের সাধক ও সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত
প্রণয় সেন
প্রণয়
গুরু খণ্ড হইলেও পরমতত্ত্বের সাক্ষাৎকার না করিয়া থাকিলে তাঁহাকে সদ্গুরু বলা যায় না। কিন্তু খণ্ডগুরুর প্রদত্ত জ্ঞানের মধ্যে পূর্ণতার অভাববশতঃ একটা ক্রমিক ভাব বা তারতম্য বিদ্যমান থাকে। তদনুসারে ইহা বলা হইয়া থাকে যে গুরু স্বয়ং যে স্তরে থাকেন শিষ্যকেও দীক্ষা দ্বারা সেই পর্যন্ত উঠাইয়া নিতে পারেন। গুরুর জ্ঞান যদি খণ্ড না হয় তাহা হইলে এই শঙ্কা উত্থিত হইতে পারে না।
শাস্ত্র অনুসারে দীক্ষা ও শক্তিপাতের মধ্যে সাধারণতঃ কিছু কিছু ভেদ প্রদর্শন করা হয়। কারণ শক্তিপাত হয় সাক্ষাৎ পরমেশ্বর হইতে—কারণ তিনি ভিন্ন অনুগ্রহ করিবার যোগ্যতা আর কাহারও নাই। সাপেক্ষ অনুগ্রহ নিম্নস্তর হইতেও হইতে পারে। কিন্তু পরম অনুগ্রহ করিবার যোগ্যতা একমাত্র ভগবানেরই আছে। পরম অনুগ্রহের ফলে শিবত্ব লাভ হয়। খণ্ড অনুগ্রহের ফলে নানা প্রকার উচ্চ অবস্থা লাভ হইতে পারে। যে জীবে শক্তিপাত হইয়াছে একমাত্র সেই জীবই দীক্ষা লাভের উপযুক্ত। আচার্য গুরু জ্ঞানী হইলে দৃষ্টিমাত্র বুঝিতে পারেন কাহারও শক্তিপাত হইয়াছে কিনা। যাহাতে শক্তিপাত হয় নাই এইরূপ জীবকে জ্ঞানীগুরু কখনই দীক্ষা দিতে অগ্রসর হন না। দীক্ষা ক্রিয়াশক্তির কার্য। মূলে ইহা পরিপূর্ণ জ্ঞান ও ক্রিয়ার অভিন্নতাময় চিৎশক্তির ব্যাপার। সৃষ্টির পূর্বে বিদেহ আত্মাকে যে ভগবান্ স্বয়ং দীক্ষা দেন সেখানে জ্ঞান-শক্তি ও ক্রিয়া-শক্তির পার্থক্য থাকে না, যদিও আধার-ভেদ অনুসারে সঞ্চারিত শক্তির মাত্রার তারতম্য থাকে। সৃষ্টির অভ্যন্তরে পূর্ণ জ্ঞান ও ক্রিয়ার অভিন্নতাময় চিৎশক্তির ব্যাপার। সৃষ্টির পূর্বে বিদেহী আত্মাকে যে ভগবান্ স্বয়ং দীক্ষা দেন সেখানে জ্ঞান-শক্তি ও ক্রিয়া-শক্তির পার্থক্য থাকে না, যদিও আধারভেদ অনুসারে সঞ্চারিত শক্তির মাত্রার তারতম্য থাকে সৃষ্টির অভ্যন্তরে দেহবিশিষ্ট জীবকে অনুগ্রহ করিতে হইলে ক্রিয়া-শক্তির ব্যাপারটি আচার্যকে অবলম্বন করিতে হয় বলিয়া শক্তিপাতের মূল ব্যাপারটি শুধু ভগবৎ সাপেক্ষ থাকে। শক্তিপাতের তাৎপর্য এই যে জীব-বিশেষ উঠাইয়া নিবার জন্য ভগবান্ ইচ্ছা করিয়াছেন, অর্থাৎ জীব-বিশেষের উপর ভগবানের করুণাদৃষ্টি রহিয়াছে। ভগবানের এই করুণাদৃষ্টির দিকে লক্ষ্য করিয়াই আচার্য দীক্ষা দানে অগ্রসর হন। দীক্ষার ফলে, জ্ঞান ও ক্রিয়া উভয় শক্তিরই সঞ্চার হয়। ক্রিয়া শক্তির মাত্রা থাকে আংশিক।
সাধারণতঃ পুরুষই গুরু হয়—স্ত্রী গুরু হইতে পারে না। যখন স্ত্রী শরীর দীক্ষা দান করে তখন বুঝিতে হইবে তাঁহার মধ্যে পুরুষ শরীর কাজ করিতেছে। শ্রীশ্রীসিদ্ধিমাতাকে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিয়াছিলেন তাঁহার মধ্যে নারায়ণ রহিয়াছেন, তিনি দীক্ষা দেন। স্ত্রী শরীর কিছু ন্যূনতা রহিয়াছে। ইহার ব্যতিক্রমও আছে শাস্ত্রে। যখন স্ত্রী শরীর ব্রহ্মজ্ঞান বা আত্মজ্ঞান লাভ করে তখন তাঁহার দীক্ষা দিবার অধিকার জন্মে কেননা আত্মা পুরুষ।
আলোচনাপ্রসঙ্গে বলিলেন দীক্ষার বিষয় নিয়ে একটা বড় কাজ করা যায়। দীক্ষার সময় গুরু কি দেখেন? কিছুক্ষণ পর উত্তরদান প্রসঙ্গে বলিলেন প্রত্যেক ব্যক্তির ‘অহং’— ‘অ’ হইতে ‘হ’ বর্ণমালা ৫০টি মাতৃকার দ্বারা গঠিত। কিন্তু সেই বর্ণমালার যে আদর্শ সংগঠন তাহা হইতে কিছু কম বেশী থাকে যেমন ‘চ’-এর ৫ থাকার কথা, হয়তো আছে ৯; আর ‘ছ’-এর ৬ থাকার কথা আছে ৪; যেমন যে বর্ণমালার যতটুকু প্রয়োজন সেই সামরস্যের প্রতিষ্ঠা করাই দীক্ষার উদ্দেশ্য।
সদ্গুরু আলিঙ্গনের সময় সেই সামরস্য স্থাপন করিয়া দেন। তারপর হয়তো সেই ব্যক্তির জাগতিক জীবনের আচার ব্যবহারে কোন পরিবর্তন আসে না। কিন্তু গুরু তাহাকে ভগবদ্ উন্মুখ করিয়া দেন। যদি তিনি সাধক হন তাহা হইলে সাধনার দ্বারা এই জীবনেই পরমবস্তু লাভ করিয়া জীবন্মুক্ত হইতে পারেন। নতুবা দেহরক্ষার পর তাঁহার মুক্তি অবশ্যম্ভাবী। এই সামরস্য স্থাপনের সময়ও বৈয়ক্তিক স্বাতন্ত্র্য থাকে। যেমন কবিরাজি চিকিৎসায় কবিরাজ রোগীর বায়ু, পিও, কাফের সামরস্য দেখেন। যদি সামরস্য না থাকে, সামরস্য আনিবার জন্য ঔষধ দিয়া থাকেন পূর্ণরূপে রোগ নিরাময়ের জন্য।
পূর্বের তিন জন্মের সংস্কার-সাপেক্ষ ভাবে পরিদর্শন করিয়া সাধন জীবনের ধারাটি আবিষ্কার করিতে হয়। সাধনা ষোল আনা পূর্ণ হইলে একই পরম লক্ষ্যে উপনীত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। যে মার্গে সাধকের অধিক পরিশ্রম হইয়া থাকে এবং তজ্জন্য সাধন সংস্কার অধিক বর্ত্তমান থাকে সেই মার্গই বর্ত্তমানে উক্ত সাধকের পক্ষ অবলম্বনীয়। তাহা হইলে পরিশ্রমের অনেকটা লাঘব হয় এবং পূর্ব জন্মের কৃত কর্ম বর্ত্তমান জন্মে ফলসিদ্ধির সহায়ক হয়।
কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে ইহা একটি স্থূল ব্যাপার মাত্র। গত তিন জন্ম তো দূরের কথা, ঐ প্রকার সহস্র জন্ম বিচার করিলেও প্রকৃত পথের সন্ধান পাওয়া যাইবে না। ঐ তিন জন্ম বস্তুতঃ এক জন্মেরই ত্রিবিধ বিলাস মাত্র। স্থূলদেহ ধারণই স্থূল জগতে অর্থাৎ ভৌতিক স্তরে প্রবেশে চিহ্নস্বরূপ। স্থূলদেহ সর্ব্বপ্রথম কখন গ্রহণ করা হইয়াছিল ইহার ইতিহাস কেহ বলিতে পারে না। স্থূলদেহ জাত হয় এবং মৃত হয়—এই প্রকার জন্ম-মৃত্যু যে কতবার হইয়া গিয়াছে তাহারও সন্ধান কেহ জানে না। কালের জগতে নামিয়া আসা জন্ম-মৃত্যুর অধীন হওয়া, কিন্তু এই স্থূলদেহে প্রবেশ কোথা হইতে হইয়াছে তাহা জানা আবশ্যক। যদি সেই সন্ধান পাওয়া যায় তাহা হইলে সেখান হইতে আরও ঊর্দ্ধে উঠিয়া সন্ধান নিতে হইবে যে মৌলিক আবরণ সর্বপ্রথম কোন সূত্রে শুদ্ধ চৈতন্যকে গ্রাস করিয়া থাকে।
শ্রীশ্রীগুরুদেব তাঁহার ‘‘প্রকৃতি তত্ত্বে’’ বলিয়াছেন—‘‘স্বভাবের ধারা ত্রিধা সৃষ্টি করা।’’ এই যে ত্রিবিধ সৃষ্টি ইহাই বস্তুতঃ আত্মার তিনটি জন্ম। এই তিনটি জন্মের বৃত্তান্ত নিপুণ-দৃষ্টিতে দেখিতে না পারিলে সেই মায়িক জগৎ হইতে পরম স্থানে পৌঁছিবার ধারাটি খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। পরম পথকে আবিষ্কার করাই দীক্ষার উদ্দেশ্য। এই তিন জন্মের মধ্য দিয়াই, অর্থাৎ এই ত্রিবিধ স্তর ভেদ করিয়াই, এই পথটি প্রসারিত রহিয়াছে। কোন সাধকের প্রকৃতি নির্ণয় করিতে হলে তাহার মায়িক দেহ, মহামায়িক দেহ এবং চিন্ময় দেহের প্রকৃতি অবগত হওয়া আবশ্যক।
বিশুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপতঃ নিরাকার ও নির্মল চিদবস্তু। যখন সৃষ্টি মুখে উহা কালের রাজ্যে আগত হয় তখন প্রকৃতির বিভিন্ন স্তর ভেদ করিয়া উহাকে আসিতে হয়।
গোপীনাথ কবিরাজের ‘সাধনা ও সিদ্ধি’
ভারতের সাধক ও সাধিকা
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নূতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নূতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।
ভারতের সাধক ও সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত
প্রণয় সেন
প্রণয়
0 comments :
Post a Comment