‘ভাবপ্রচার ও সংগঠন’

সংগঠন বা দলবদ্ধ প্রয়াস অর্থাৎ Team Work একালের যুগলক্ষণ—তাহা স্বামীজী বুঝিয়াছিলেন। মানুষের আধ্যাত্ম-জীবনেও এই দলবদ্ধ প্রচেষ্টা এযুগের বিশেষত্ব, সেকথা এই একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমরা যথেষ্টই উপলব্ধি করিতেছি। 
কিন্তু বিশ্বায়নের নামে ধর্মকে পণ্য করা বা Consumerism-এর স্তরে এই অধ্যাত্ম প্রচেষ্টাকে টানিয়া নামাইতে স্বামীজী কখনোই বলেন নাই। 
বরং বৌদ্ধধর্মের প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে Institutionalised Religion বা সঙ্ঘবদ্ধভাবে ধর্মপ্রচারের যেসব দোষ তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইয়াছিল, সে-ব্যাপারে প্রতি পদে গুরুভাই এবং শিষ্যদিগকে সাবধান করিয়া দিয়াছেন। একদা আমেরিকার সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন নিজ পুত্রের গৃহশিক্ষককে একটি অসাধারণ পত্র লিখিয়াছিলেন। 


ঐ পত্রে তিনি গৃহশিক্ষককে অনুরোধ করিয়াছিলেন: ‘‘আপনি আমার পুত্রকে শিক্ষা দিবেন—কি করিয়া নিজেকে সর্বোত্তম ক্রেতার নিকট উৎসর্গ করিতে হয়, কিন্তু কখনোই সে যেন নিজের বুকের উপর একটি মূল্যলেখা কাগজ না লাগায় [যে আমার দাম এত ডলার]।’’ মঠের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মবিধি রচনা করিয়া স্বামীজী স্পষ্টভাষায় বলিলেন: ‘‘অপরের নামে গোপনে নিন্দা করা ভ্রাতৃভাব বিচ্ছেদের প্রধান কারণ। অতএব কেহই তাহা করিবে না। যদি কোনও ভ্রাতার বিরুদ্ধে কিছু বলিবার থাকে তো একান্ত তাহাকেই বলা হইবে।’’
কেবল ধর্মীয় সংগঠন নহে, যেকোন সংগঠনের ক্ষেত্রেই ঈর্ষা, অসহিষ্ণুতা, পরস্পরের নামে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে নালিশ করা এবং সংগঠনের সুনাম ও জনগণের আস্থাকে মূলধন করিয়া নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টা সেই সংগঠনের বিনাশের কারণ হয়। যে-পৃথিবীর মাটিতে আমরা দাঁড়াইয়া আছি, উহাকেই যদি বারংবার ক্ষতিগ্রস্ত করিতে চেষ্টা করি, ভবিষ্যতে আমাদের দাঁড়াইবার স্থান থাকিবে না। স্বামীজী চাহিতেন, যখনি কিছু মনোমত হইল না, তখনি তাহা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে যথাযথ ভদ্রোচিত ভাষায় জানানো দরকার। অপরপক্ষে প্রত্যেকের মধ্যে এমন উদারতা থাকিবে যে, সংগঠনের অন্যান্য সভ্যবৃন্দের সামনে নিজের দোষ স্বীকার করিতে তাঁহার কুণ্ঠা থাকিবে না, কিংবা কেহ তাঁহার দোষ উল্লেখ করিলে তাহা ধৈর্য সহকারে শুনিতে তিনি দ্বিধা করিবেন না। 
‘আমি যাহা করিয়াছি তাহাই ঠিক, যাহা বুঝিয়াছি তাহাই ঠিক, অপরে যাহা করিয়াছেন কিংবা বুঝিয়াছে তাহা ঠিক নহে।’—এইরূপ ধৃষ্টতা সংগঠনের পক্ষে ক্ষতিকারক এবং সকলের পক্ষে অসম্মানজনক। ভুল করা মানবিক গুণ। এমন কখনো হইতে পারে না যে, মানুষ কখনো ভুল করিবে না। কিন্তু পারস্পরিক অহঙ্কারবিবর্জিত প্রেমের সম্পর্ক থাকিলে সেই ভুল, ব্যক্তিগত বা দলগত যে-স্তরেই হউক, সহজে সংশোধন বা নির্মূল করা সম্ভব হয়। ইহা একধরনের ‘art of living’ বা বাঁচার শিল্প। শ্রীশ্রীমায়ের জীবনের অপূর্ব সহিষ্ণুতা, সর্বগ্রাহিতা, অপরকে প্রাপ্য মর্যাদা প্রদানের সামর্থ্য, সকল আশ্রিতের আহার ও থাকার যথাযথ ব্যবস্থাদি করা এবং ঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত লইবার ক্ষমতা দেখিয়া আমরা বুঝিতে পারি, অশান্তির নিলয় এই জগৎ-সংসারে যথার্থ art of living কাহাকে বলে।
যে-সংগঠনে কেবল পরস্পরের প্রতি দোষারোপ কিংবা আন্তর রাজনীতি অথবা ক্ষুদ্র স্বার্থের পরিপূর্তি রহিয়াছে, সেখানে প্রেমের পরিবর্তে বিদ্বেষ, হিংসা, প্রিয়জনের রক্তচক্ষু বিরাজ করে। এই ধরনের সংগঠনের দীর্ঘজীবিত্ব অসম্ভব। কেবল পুঁথিগতভাবে নয়, সাম্প্রতিক ইতিহাস ও পারিপার্শ্বিক অস্থির সামাজিক চালচিত্র হইতে এই শিক্ষা আমরা এখন চাক্ষুষ লাভ করিতেছি।
সংগঠনের সকল কর্মীরই সমান অভিজ্ঞতা থাকিবে, তাহা আশা করা যায় না। বড় কর্মী আমরা তাঁহাকেই বলি যাঁহার অভিজ্ঞতা বেশি, যিনি উদ্যমী, প্রেমিক এবং সিদ্ধান্তে ভুল কম হয়। তাঁহার বয়সের সহিত ইহার কোন সম্পর্ক নাই। কিন্তু যে-কোন সদস্যেরই, বড় বা ছোট, সাংগঠনিক গুরুত্ব নির্ধারিত হয় মূলত তাহার চারিত্রিক শুদ্ধতার দ্বারাই। পূর্বের প্রসঙ্গ টানিয়া স্বামীজী বলিলেন:
‘‘At any cost, any price, any sacrifice (ইহার জন্য যতই ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করিতে হউক না কেন) ঐটি [ঈর্ষা] আমাদের মধ্যে না ঢোকে—আমরা দশজন হই, দুজন হই, do not care (কুছ পরোয়া নাই), কিন্তু ঐ কয়টা [ঐ গুটিকয়েক—দশজন কিংবা দুজন] perfect character [সর্বাঙ্গসুন্দর ও নির্দোষ চরিত্র] হওয়া চাই। আমাদের ভিতর যিনি পরস্পরের গুজুগুজু নিন্দা করবেন বা শুনবেন, তাকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। ঐ গুজুগুজু সকল নষ্টের গোড়া। বুঝতে পারছ কি? হাত ব্যথা হয়ে এল... আর লিখতে পারি না। 
‘মাঙ্গ্‌না ভালা ন বাপ্‌সে যব্‌ রঘুবীর রাখে টেক্‌’। রঘুবীর টেক রাখেন দাদা, সেবিষয়ে তোমরা নিশ্চিন্ত থেকো।’’ (১৮৯৪ সালে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত পত্র) বিদ্যাচর্চা: ‘‘বিদ্যার অভাবে ধর্মসম্প্রদায় নীচদশাপ্রাপ্ত হয়। অতএব সর্বদা বিদ্যার চর্চা থাকিবে।’’ সঙ্ঘের বুনিয়াদী শিক্ষার নিয়মনীতি নির্ধারণকালে স্বামীজী এই কথা বলিয়া প্রত্যহ মঠে শাস্ত্রচর্চার জন্য উপদেশ করিয়াছিলেন। স্বামীজীর দেহত্যাগের পর স্বামী শিবানন্দজী মহারাজ মঠের সন্ন্যাসি-ব্রহ্মচারীদের বারবার বলিতেন: ‘‘স্বামীজীর বই পড়ো।’’ কারণ, স্বামীজীকে ‘ঘনীভূত ভারতবর্ষ’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন ঋষি অরবিন্দ। রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন: ‘‘যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও বিবেকানন্দকে পড়ো।’’ ভারতবর্ষের পাঁচ সহস্র বৎসরের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যসহ এজাতির যাবতীয় পতন ও অভ্যুদয়ের সারাংশ বিবেকানন্দের ‘বাণী ও রচনা’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত আছে। তাই ভারতবর্ষকে জানিতে গেলে ‘বিবেকানন্দ’ পড়িতে হইবে।

স্বামী সর্বগানন্দের ‘ভাবপ্রচার ও সংগঠন’ 


আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নূতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নূতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।

ভারতের সাধক ও সাধিকা
      পুণঃপ্রচারে বিনীত 
            প্রণয় সেন
               প্রণয়
Share on Google Plus

About Indian Monk - Pronay Sen

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.

0 comments :

Post a Comment