"আমি চল্লিশ পেরােবাে না। যে-বাণী দেওয়ার ছিল, তা আমি দিয়ে দিয়েছি। আমাকে যেতে হবেই! বড় গাছের ছায়ায় ছােট ছােট গাছগুলাে বাড়তে পারে না। তাদের জায়গা করে দেবার জন্যই আমাকে যেতে হবে।" ( স্মৃতির আলোয় বিবেকানন্দ)
তুমিই জিতলে! তোমার কথা যে বেদবাক্য, তা আবার প্রমানিত হলো । তুমি ৪০ দেখলে না; ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিনের মাথাতেই তুমি বিদায় নিলে।
"১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই। প্রত্যুষে গাত্রোত্থান করিয়া স্বামিজী আজ সকলের সহিত একত্রে, ধ্যান করিতে গেলেন না, অতীতের কথা তুলিয়া নানাবিধ গল্প করিতে লাগিলেন। পরদিবস অমাবস্যা ও শনিবার বলিয়া মঠে শ্রীশ্রীকালীপূজা করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। পূজার আয়ােজন সম্বন্ধে কথাবার্তা চলিতেছে, এমন সময় স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের পিতা শক্তিসাধক ও তন্ত্রশাস্ত্রে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয় মঠে আগমন করিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া স্বামিজী আনন্দিত হইলেন। ভট্টাচার্য মহাশয়ের সহিত পরামর্শ করিয়া স্বামিজী তখনই স্বামী শুদ্ধানন্দ ও বােধানন্দজীকে পূজার আবশ্যক বন্দোবস্ত করিবার আদেশ প্রদান করিলেন। অতঃপর কিঞ্চিৎ চা পান করিয়া মঠের ঠাকুরঘরে প্রবেশ করিলেন। কিয়ৎকাল পরেই দেখা গেল, ঠাকুরঘরের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। এরূপভাবে তিনি তাে কোনদিনই দরজা-জানালা রুদ্ধ করিয়া দেন না, ইহার কারণ কি? কে বলিবে! সুদীর্ঘ তিনঘণ্টা কাল অতিবাহিত হইলে একটি শ্যামাসঙ্গীত (শ্যামা মা কি আমার কালো) গাহিবার পর, ভাবানন্দে মগ্ন মহাপুরুষ ধীরে ধীরে সােপান বাহিয়া অবতরণ করিলেন। “মন, চল নিজ নিকেতনে” গানটি গুনগুন করিয়া গাহিতে গাহিতে মঠের প্রাঙ্গণে পদচারণা করিতে লাগিলেন। আজ মনে হয় সেই দিনের কথা, যেদিন প্রথম গুরু-শিষ্য সাক্ষাৎ। সেদিন বালক নরেন্দ্রনাথ ভাবানন্দে গদগদ হইয়া দক্ষিণেশ্বরের পবিত্র দেবালয়ে এই গানটি গাহিয়াছিলেন...। পদচারণা করিতে করিতে আত্মস্থ মহাযােগী কি তাহাই ভাবিতেছেন? আপনা-আপনি একান্তে তিনি ঈষৎ অনুচ্চস্বরে যেন কি বলিতেছেন। স্বামী প্রেমানন্দজী অদুরে দাঁড়াইয়াছিলেন, তিনি শুনিতে পাইলেন, স্বামিজী আপন মনে বলিতেছেন, 'যদি এখন আর একজন বিবেকানন্দ থাকিত, তাহা হইলে সে বুঝিতে পারি, বিবেকানন্দ কি করিয়াছে। কিন্তু কালে অবশ্য অনেক বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করিবে।' স্বামী প্রেমানন্দজী চমকিত হইলেন। কারণ
তিনি জানিতেন, স্বামিজীর মন উচ্চতম ভাবভূমিতে আর না হইলে এসব কথা তিনি কখনও তাে বলেন না। মহামায়ার খেলা কে বুঝিবে?......
নিয়মিত সময়ে আহারের ঘণ্টাধবনি হইবামাত্র স্বামিজী ঠাকুরঘরের নিন্দতলের বারান্দায় সকলের সহিত এক মিলিত হইয়া আহারে উপবেশন করিলেন। স্বামিজী অসুখের পর হইতে সাধারণতঃ সকলের সহিত একত্র আহার করিতেন না। আজ সহসা সে নিয়মের ব্যতিক্রম দেখিয়াও কাহারও হয়ে কোন সন্দেহের উদয় হইল না, বরং অপ্রত্যাশিতভাবে স্বামিজীর সহিত একর আহার করিবার সৌভাগ্য লাভ করিয়া সকলেই আনন্দিত হইলেন। স্বামিজী স্বাভাবিক আগ্রহের সহিত আহার করিতে লাগিলেন এবং গুরুভ্রাতাগণের সহিত কৌতুকালাপে রত হইলেন। কথাপ্রসঙ্গে বলিলেন, অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ তাঁহার শরীর যথেষ্ট ভাল বােধ হইতেছে।
ভােজনান্তে কিয়ৎকাল বিশ্রাম করিয়াই স্বামিজী ব্রহ্মচারিবৃন্দকে সংস্কৃত ক্লাসে আহ্বান করিলেন। অন্যান্য দিন আড়াইটা তিনটার সময় পাঠ আরম্ভ হইত, আজ একটা বাজিতে পনর মিনিট গত না হইতেই পাঠ আরম্ভ হইল। লঘুকৌমুদী ব্যাকরণ পাঠ চলিতে লাগিল, বিষয়টি নীরস হইলেও দীর্ঘ তিনঘণ্টাকালের মধ্যে কেহ কোনপ্রকার বিরতি বােধ করেন নাই। কখনও হাস্যোদ্দীপক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্প দিয়া, কখনও সুত্ৰগলির বিভিন্ন প্রকার কৌতুকাবহ ব্যাখ্যা করিয়া কঠিন কঠিন স্থলগুলিও স্বামিজী সহজবােধ্য ও হৃদয়গ্রাহী করিয়া তুলিতে লাগিলেন। প্রসঙ্গক্রমে স্বামিজী বলিলেন, এইরূপ গল্প, উপমা ও কৌতুকের সহিত তিনি একদিন তাঁহার সহাধ্যায়ী বন্ধু দাশরথি সান্ন্যাল (হাইকোর্টের উকীল) মহাশয়কে একরাত্রের মধ্যে ইংলণ্ডের ইতিহাস শিক্ষা দিয়াছিলেন। ব্যাকরণ অধ্যাপনা সমাপ্ত হইলে স্বামিজীকে কিঞ্চিৎ পরিশ্রান্ত বােধ হইল।
অপরাহ্নে স্বামিজী, স্বামী প্রেমানন্দজীকে সঙ্গে লইয়া মঠের বাহিরে ভ্রমণে বহির্গত হইলেন। সেদিন উভয়ে গল্প করিতে করিতে বেলুড় বাজার পর্যন্ত গিয়াছিলেন। নানাকথার সহিত বেদ বিদ্যালয়ের কথাও উঠিল। স্বামী প্রেমানন্দ প্রশ্ন করিলেন, 'স্বামিজী! বেদপাঠে কি উপকার সাধিত হইবে?" স্বামিজী তৎক্ষণাৎ গভীর ভাবপূর্ণ অথচ স্বল্প কথায় উত্তর দিলেন, “অন্ততঃ ইহা অনেক কুসংস্কার বিনষ্ট করিবে।”....সন্ধ্যারতির সময় আগত দেখিয়া ব্রহ্মচারিবৃন্দ একে একে স্বামিজীকে প্রণাম করিয়া ঠাকুরঘরে প্রস্থান করিলেন। আচার্যদেব ধীরে ধীরে দ্বিতলে স্বীয় শয়নকক্ষে উপস্থিত হইলেন।
একজন ব্রহ্মচারী সর্বদাই স্বামিজীর সঙ্গে সঙ্গে থাকিতেন তাহাকে (ব্রজেন্দ্র) স্বামিজী সমস্ত দরজা-জানালাগুলি খুলিয়া দিবার আদেশ দিলেন। ....আত্মমগ্ন বিবেকানন্দ ধীরে ধীরে পূর্বদিকের বাতায়নে দাঁড়াইয়া দক্ষিণেশ্বরের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন! সেই অন্ধকার ভেদ করিয়া তাহার দিব্যদৃষ্টি কি দেখিতেছিল—কে বলিবে? বহুদিন পূর্বে কাশীপুরের বাগানবাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণ যে অনুভূতির দ্বার বন্ধ করিয়াছিলেন, আজ কি কৰ্মশ্রান্ত সন্ন্যাসীর নির্নিমেষ দৃষ্টির সম্মুখে তাহা ধীরে ধীরে উন্মত্ত হইতেছে?বিবেকানন্দের জ্ঞান দৃষ্টির সম্মুখে শ্রীরামকৃষ্ণকথিত “কাগজের মতাে পাতলা” যে আবরণ ছিল, সেই রহস্য-যবনিকাখানি ধীরে ধীরে উত্তোলিত হইয়া কি চরম আত্মােপলব্ধির আনন্দ-নিকেতন উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল! বহুক্ষণ পর যেন সম্বিত পাইয়া বিবেকানন্দ ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। ব্রহ্মচারিজীকে বাহিরে বসিয়া জপ করিতে আদেশ দিয়া স্বয়ং জপমালা হস্তে পদ্মাসনে উপবেশন করিলেন। একঘণ্টা পর আসন হইতে উত্থিত হইয়া স্বামিজী কক্ষ-কুট্টিমে শায়িত হইলেন এবং ব্রহ্মচারীকে আহান করিয়া বাতাস করিতে বলিলেন।
জপমালাহস্তে শায়িত মহাপুরুষের দেহ নিষ্পন্দ ও স্থির। রাত্রি তখন ৯টা বাজিয়াছে, এমন সময় তাঁহার হস্ত কম্পিত হইল এবং সঙ্গে সঙ্গে নিদ্রিত শিশুর মত অস্ফুটস্বরে একটু ক্রন্দন করিয়া উঠিলেন। দুইটি গভীর দীর্ঘশ্বাস পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাহার মস্তক উপাধান হইতে হেলিয়া পড়িল। স্বামিজীকে তদবস্থায় দেখিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় ব্রহ্মচারী নিম্নতলে গিয়া বয়স্ক সন্ন্যাসিগণকে সংবাদ প্রদান করিলেন। তাঁহারা আসিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, যােগিবর অনন্ত নিদ্রায় শায়িত ! অমানিশার অন্ধ তিমিরাবগুণ্ঠনের অন্তরাল হইতে জগন্মাতা তাঁহার রণশ্রান্ত বীরপুত্রকে ব্যগ্রবাহু প্রসারিত করিয়া ক্রোড়ে তুলিয়া লইলেন!"
পরিষ্কার হয়ে গেল, সাইক্লোনের আসা-যাওয়া যেমন predict করা যায় না, তোমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। আর বেশি কিছু বলতে চাই না।
গুরুদেব তুমি প্রণাম নিও ।।
কিন্তু শেষ করার আগে বলতে চাই, ওই দিনে স্বামী প্রেমানন্দকে বলা তোমার কথা গুলো যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায় -
'যদি এখন আর একজন বিবেকানন্দ থাকিত, তাহা হইলে সে বুঝিতে পারি, বিবেকানন্দ কি করিয়াছে। কিন্তু কালে অবশ্য অনেক বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করিবে।
বিবেকানন্দ চরিত - সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার
স্বামীজী ও তাঁর বাণী
তুমিই জিতলে! তোমার কথা যে বেদবাক্য, তা আবার প্রমানিত হলো । তুমি ৪০ দেখলে না; ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিনের মাথাতেই তুমি বিদায় নিলে।
১৯০২ সালের ৪ ঠা জুলাই, অর্থাৎ আজকের এই দিনে কর্মযোগী বিবেকানন্দ কর্ম ত্যাগ করেন রাত ৯ টা বেজে ১০ মিনিটে। কিন্তু সারাটা দিন তুমি যে ভাবে কাটিয়েছিলে, তাতে তোমার এই বিদায়ের কোনো ইঙ্গিতই ছিলো না! আমি তো কোনো ভুল বলছি না; তাহলে দেখে নিই তোমার সেদিনের দিনযাপনের কাহিনীগুলি 👇👇👇👇
"১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই। প্রত্যুষে গাত্রোত্থান করিয়া স্বামিজী আজ সকলের সহিত একত্রে, ধ্যান করিতে গেলেন না, অতীতের কথা তুলিয়া নানাবিধ গল্প করিতে লাগিলেন। পরদিবস অমাবস্যা ও শনিবার বলিয়া মঠে শ্রীশ্রীকালীপূজা করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। পূজার আয়ােজন সম্বন্ধে কথাবার্তা চলিতেছে, এমন সময় স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের পিতা শক্তিসাধক ও তন্ত্রশাস্ত্রে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয় মঠে আগমন করিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া স্বামিজী আনন্দিত হইলেন। ভট্টাচার্য মহাশয়ের সহিত পরামর্শ করিয়া স্বামিজী তখনই স্বামী শুদ্ধানন্দ ও বােধানন্দজীকে পূজার আবশ্যক বন্দোবস্ত করিবার আদেশ প্রদান করিলেন। অতঃপর কিঞ্চিৎ চা পান করিয়া মঠের ঠাকুরঘরে প্রবেশ করিলেন। কিয়ৎকাল পরেই দেখা গেল, ঠাকুরঘরের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। এরূপভাবে তিনি তাে কোনদিনই দরজা-জানালা রুদ্ধ করিয়া দেন না, ইহার কারণ কি? কে বলিবে! সুদীর্ঘ তিনঘণ্টা কাল অতিবাহিত হইলে একটি শ্যামাসঙ্গীত (শ্যামা মা কি আমার কালো) গাহিবার পর, ভাবানন্দে মগ্ন মহাপুরুষ ধীরে ধীরে সােপান বাহিয়া অবতরণ করিলেন। “মন, চল নিজ নিকেতনে” গানটি গুনগুন করিয়া গাহিতে গাহিতে মঠের প্রাঙ্গণে পদচারণা করিতে লাগিলেন। আজ মনে হয় সেই দিনের কথা, যেদিন প্রথম গুরু-শিষ্য সাক্ষাৎ। সেদিন বালক নরেন্দ্রনাথ ভাবানন্দে গদগদ হইয়া দক্ষিণেশ্বরের পবিত্র দেবালয়ে এই গানটি গাহিয়াছিলেন...। পদচারণা করিতে করিতে আত্মস্থ মহাযােগী কি তাহাই ভাবিতেছেন? আপনা-আপনি একান্তে তিনি ঈষৎ অনুচ্চস্বরে যেন কি বলিতেছেন। স্বামী প্রেমানন্দজী অদুরে দাঁড়াইয়াছিলেন, তিনি শুনিতে পাইলেন, স্বামিজী আপন মনে বলিতেছেন, 'যদি এখন আর একজন বিবেকানন্দ থাকিত, তাহা হইলে সে বুঝিতে পারি, বিবেকানন্দ কি করিয়াছে। কিন্তু কালে অবশ্য অনেক বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করিবে।' স্বামী প্রেমানন্দজী চমকিত হইলেন। কারণ
তিনি জানিতেন, স্বামিজীর মন উচ্চতম ভাবভূমিতে আর না হইলে এসব কথা তিনি কখনও তাে বলেন না। মহামায়ার খেলা কে বুঝিবে?......
নিয়মিত সময়ে আহারের ঘণ্টাধবনি হইবামাত্র স্বামিজী ঠাকুরঘরের নিন্দতলের বারান্দায় সকলের সহিত এক মিলিত হইয়া আহারে উপবেশন করিলেন। স্বামিজী অসুখের পর হইতে সাধারণতঃ সকলের সহিত একত্র আহার করিতেন না। আজ সহসা সে নিয়মের ব্যতিক্রম দেখিয়াও কাহারও হয়ে কোন সন্দেহের উদয় হইল না, বরং অপ্রত্যাশিতভাবে স্বামিজীর সহিত একর আহার করিবার সৌভাগ্য লাভ করিয়া সকলেই আনন্দিত হইলেন। স্বামিজী স্বাভাবিক আগ্রহের সহিত আহার করিতে লাগিলেন এবং গুরুভ্রাতাগণের সহিত কৌতুকালাপে রত হইলেন। কথাপ্রসঙ্গে বলিলেন, অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ তাঁহার শরীর যথেষ্ট ভাল বােধ হইতেছে।
ভােজনান্তে কিয়ৎকাল বিশ্রাম করিয়াই স্বামিজী ব্রহ্মচারিবৃন্দকে সংস্কৃত ক্লাসে আহ্বান করিলেন। অন্যান্য দিন আড়াইটা তিনটার সময় পাঠ আরম্ভ হইত, আজ একটা বাজিতে পনর মিনিট গত না হইতেই পাঠ আরম্ভ হইল। লঘুকৌমুদী ব্যাকরণ পাঠ চলিতে লাগিল, বিষয়টি নীরস হইলেও দীর্ঘ তিনঘণ্টাকালের মধ্যে কেহ কোনপ্রকার বিরতি বােধ করেন নাই। কখনও হাস্যোদ্দীপক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্প দিয়া, কখনও সুত্ৰগলির বিভিন্ন প্রকার কৌতুকাবহ ব্যাখ্যা করিয়া কঠিন কঠিন স্থলগুলিও স্বামিজী সহজবােধ্য ও হৃদয়গ্রাহী করিয়া তুলিতে লাগিলেন। প্রসঙ্গক্রমে স্বামিজী বলিলেন, এইরূপ গল্প, উপমা ও কৌতুকের সহিত তিনি একদিন তাঁহার সহাধ্যায়ী বন্ধু দাশরথি সান্ন্যাল (হাইকোর্টের উকীল) মহাশয়কে একরাত্রের মধ্যে ইংলণ্ডের ইতিহাস শিক্ষা দিয়াছিলেন। ব্যাকরণ অধ্যাপনা সমাপ্ত হইলে স্বামিজীকে কিঞ্চিৎ পরিশ্রান্ত বােধ হইল।
অপরাহ্নে স্বামিজী, স্বামী প্রেমানন্দজীকে সঙ্গে লইয়া মঠের বাহিরে ভ্রমণে বহির্গত হইলেন। সেদিন উভয়ে গল্প করিতে করিতে বেলুড় বাজার পর্যন্ত গিয়াছিলেন। নানাকথার সহিত বেদ বিদ্যালয়ের কথাও উঠিল। স্বামী প্রেমানন্দ প্রশ্ন করিলেন, 'স্বামিজী! বেদপাঠে কি উপকার সাধিত হইবে?" স্বামিজী তৎক্ষণাৎ গভীর ভাবপূর্ণ অথচ স্বল্প কথায় উত্তর দিলেন, “অন্ততঃ ইহা অনেক কুসংস্কার বিনষ্ট করিবে।”....সন্ধ্যারতির সময় আগত দেখিয়া ব্রহ্মচারিবৃন্দ একে একে স্বামিজীকে প্রণাম করিয়া ঠাকুরঘরে প্রস্থান করিলেন। আচার্যদেব ধীরে ধীরে দ্বিতলে স্বীয় শয়নকক্ষে উপস্থিত হইলেন।
একজন ব্রহ্মচারী সর্বদাই স্বামিজীর সঙ্গে সঙ্গে থাকিতেন তাহাকে (ব্রজেন্দ্র) স্বামিজী সমস্ত দরজা-জানালাগুলি খুলিয়া দিবার আদেশ দিলেন। ....আত্মমগ্ন বিবেকানন্দ ধীরে ধীরে পূর্বদিকের বাতায়নে দাঁড়াইয়া দক্ষিণেশ্বরের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন! সেই অন্ধকার ভেদ করিয়া তাহার দিব্যদৃষ্টি কি দেখিতেছিল—কে বলিবে? বহুদিন পূর্বে কাশীপুরের বাগানবাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণ যে অনুভূতির দ্বার বন্ধ করিয়াছিলেন, আজ কি কৰ্মশ্রান্ত সন্ন্যাসীর নির্নিমেষ দৃষ্টির সম্মুখে তাহা ধীরে ধীরে উন্মত্ত হইতেছে?বিবেকানন্দের জ্ঞান দৃষ্টির সম্মুখে শ্রীরামকৃষ্ণকথিত “কাগজের মতাে পাতলা” যে আবরণ ছিল, সেই রহস্য-যবনিকাখানি ধীরে ধীরে উত্তোলিত হইয়া কি চরম আত্মােপলব্ধির আনন্দ-নিকেতন উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল! বহুক্ষণ পর যেন সম্বিত পাইয়া বিবেকানন্দ ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। ব্রহ্মচারিজীকে বাহিরে বসিয়া জপ করিতে আদেশ দিয়া স্বয়ং জপমালা হস্তে পদ্মাসনে উপবেশন করিলেন। একঘণ্টা পর আসন হইতে উত্থিত হইয়া স্বামিজী কক্ষ-কুট্টিমে শায়িত হইলেন এবং ব্রহ্মচারীকে আহান করিয়া বাতাস করিতে বলিলেন।
জপমালাহস্তে শায়িত মহাপুরুষের দেহ নিষ্পন্দ ও স্থির। রাত্রি তখন ৯টা বাজিয়াছে, এমন সময় তাঁহার হস্ত কম্পিত হইল এবং সঙ্গে সঙ্গে নিদ্রিত শিশুর মত অস্ফুটস্বরে একটু ক্রন্দন করিয়া উঠিলেন। দুইটি গভীর দীর্ঘশ্বাস পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাহার মস্তক উপাধান হইতে হেলিয়া পড়িল। স্বামিজীকে তদবস্থায় দেখিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় ব্রহ্মচারী নিম্নতলে গিয়া বয়স্ক সন্ন্যাসিগণকে সংবাদ প্রদান করিলেন। তাঁহারা আসিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, যােগিবর অনন্ত নিদ্রায় শায়িত ! অমানিশার অন্ধ তিমিরাবগুণ্ঠনের অন্তরাল হইতে জগন্মাতা তাঁহার রণশ্রান্ত বীরপুত্রকে ব্যগ্রবাহু প্রসারিত করিয়া ক্রোড়ে তুলিয়া লইলেন!"
পরিষ্কার হয়ে গেল, সাইক্লোনের আসা-যাওয়া যেমন predict করা যায় না, তোমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। আর বেশি কিছু বলতে চাই না।
গুরুদেব তুমি প্রণাম নিও ।।
কিন্তু শেষ করার আগে বলতে চাই, ওই দিনে স্বামী প্রেমানন্দকে বলা তোমার কথা গুলো যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায় -
'যদি এখন আর একজন বিবেকানন্দ থাকিত, তাহা হইলে সে বুঝিতে পারি, বিবেকানন্দ কি করিয়াছে। কিন্তু কালে অবশ্য অনেক বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করিবে।
বিবেকানন্দ চরিত - সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার
স্বামীজী ও তাঁর বাণী
0 comments :
Post a Comment