লোকের নাথ, বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী। মহাযোগী হিসেবে বিখ্যাত। পৃথিবীতে সঙ্গ করেছেন আনুমানিক ১৬০ বছর। এই দীর্ঘ আয়ুর খবর শোনা মাত্র, আজকের ২০১৯ সালে বিষাক্ত খাদ্য ও জীবন যাপনে অভ্যস্থ, রোগশোকে জর্জরিত, হানাহানিতে লিপ্ত মানুষ চমকে উঠে কিংবা অবিশ্বাস প্রকাশ করে। ভারতীয় অধ্যাত্মজগতের অন্যতম সাধক যোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী। তাঁর সম্পর্কে তেমন বিশদ তথ্য পাওয়া যায় না। অন্যান্য সাধুগুরুজনের মতো লোকনাথ বাবার অলৌকিক কাহিনী শুনতেই লোকের আগ্রহ বেশী। তবে লিখিত আকারে লোকনাথ বাবার নামে কিছু উপদেশ প্রচলিত আছে।
গুরুকে প্রভুজ্ঞানে (নাথ=প্রভু) পিতৃজ্ঞানে ভক্তি করে শিষ্য ও সন্তানতুল্যরা। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর নামে প্রচারিত উপদেশও শিষ্য-সন্তানতুল্যরা ভক্তি নিয়ে স্মরণ করেন। এই লেখায় বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সেসব প্রচরিত উপদেশবাণীর কিছু যুক্ত করা হয়েছে এবং ‘লোক’ শব্দটির নানান অর্থ তুলে ধরা হয়েছে। বাবা লোকনাথ স্মরণে ও করণে যুক্ত থাকার নিমিত্তেই এ লেখার প্রয়াস।
দুঃখিত পীড়িত পরিত্রাণ প্রত্যাশী সমাজের মানুষ আজও বাবার কাছে যান, বাবাকে স্মরণ করেন। বাবা তাদের নাথ/প্রভু। লোকের নাথ তিনি, বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী। সর্ব্বলোক প্রসিদ্ধ। লোকরক্ষার জন্যই স্বর্গলোক হতে এমন মহতেরা ভূলোকে অবতীর্ণ হন।
এক.
বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী যাদের নাথ সেই ‘লোক’ আজও মর্যদাহীন। ছোটলোক, (জন)সাধারণ বলে তাদের পরিচয় দেওয়া হয়। ‘লোক’ শব্দটির এমন ব্যবহার হরহামেশা আমরা শুনতে পাই। যদিও আদিতে এমন ছিল না। মানব সমাজে যেমন মানবের মর্যদার ইতর-বিশেষ ঘটানো হয়েছে, শব্দসমাজেও তেমনি ইতর-বিশেষ ঘটে গিয়েছে। অন্যান্য প্রাণের ক্ষেত্রেও তাই। পিঁপড়া, মাছি, ব্যাঙ্গাচির অস্তিত্ব স্বীকার না করলে যেন কিছুই যায় আসে না। পায়ে দলাতে পারলেই মহাসুখ। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে রাসায়নিক ছিটিয়ে ফসলের জন্য উপকারী প্রাণী ধ্বংস করা হচ্ছে। লোকের শরীরের ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিষ। ‘মানুষ’ নামক কিছু ক্ষমতা প্রদর্শনকারী জীবের বাহিরে বাকী সকল প্রাণ তুচ্ছতাচ্ছিল্যের যোগ্য। লোকের এমন দশা দেখলে নিশ্চয় তাঁদের নাথেরও দুঃখ হয়। সন্তানের কষ্টে পিতা কষ্ট পান।
‘আমি নিত্য জাগ্রত। তোদের সুখে সুখী, তোদের দুঃখে দুখী। আমার বিনাশ নেই, আমি অবিনশ্বর। আমি আছি-আছি-আছি।’
দুই.
কোন কিছু অবলোকন করা না গেলে, মানুষের কাছে তা হয়ে পড়ে অলৌকিক/মিথ। ফলে অবলোকন কি করে হয়, সেও চর্চার বিষয়। কোন ঘটনা চর্মচক্ষে দেখলে আমরা সহজে বিশ্বাস করি; অন্তরচক্ষে কে কি দেখলো (লোকন করল) তা ক্যামনে বলি? তবে চর্মচক্ষে দেখতে ও সুক্ষবোধে অনুভব করতে না পারলে অনেক কথাই গল্পগুজব মাত্র, মিথ/অলৌকিক হিসেবে আখ্যায়িত হয়।
বোধের সুক্ষতার অভাবে অনেক সময় অন্যের দুঃখের কথাও আমরা অনুভব করতে পারি না, কিংবা গুরুত্বহীন মনে করি। নিজ স্থুলসত্ত্বার বাইরে অন্যসব কিছুকে পরজ্ঞানে দেখার ফলাফল এমনি হয়। কেউ আছাড় খেয়ে কোমর ভাঙ্গলে মনে মনে বলি, যাক আমি তো আছাড় খাই নাই। স্থুলবোধের, স্থুলদেহীর মন এমন স্বভাবের। সব কিছু তার কাছে বস্তুপিণ্ড মাত্র। বিরাট বস্তুবাদী! এই স্থুলবোধের কারণেই অজানা থেকে যায় অনেক রকমের সুক্ষজ্ঞান, সুক্ষবিচার।
‘আমিও তোদের মতো খাই-দাই, মল-মূত্র ত্যাগ করি। আমাকেও তোদের মতই একজন ভেবে নিস। আমাকে তোরা শরীর ভেবে ভেবেই সব মাটি করলি। আমি যে কে, তা আর কাকে বোঝাবো, সবাই তার ছোট ছোট চাওয়া নিয়েই ভুলে রয়েছে আমার প্রকৃত আমি কে।’
তিন.
যিনি শক্তি অর্থাৎ এনার্জির খবর নেন তিনি শাক্ত; সাধকের কাছেই শক্তির খবরাখবর থাকে। দেহ অর্থাৎ যন্ত্র অর্থাৎ ফর্মকে (form) আশ্রয় করে তিনি শক্তির সাধনা করেন। তেমনি বিজ্ঞানী নিকোলাই টেসলা একজন শক্তি সাধক। সে সাধনায় তিনি একদিন ‘প্রকৃত আমি’র সন্ধান পান, বোধিলাভ করেন, আত্মজ্ঞানী, ব্রহ্মজ্ঞানী হন। যোগীদের শাস্ত্র ও চর্চা আমাদের জানায়, মানুষের স্থুলদেহের মধ্যে সুক্ষ ও সুপ্তাবস্থায় শক্তিরূপিনী ‘প্রকৃত আমি’ ঘুমিয়ে থাকে; এই শক্তি লুকিয়ে আছে ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যেও। এই অর্থেই সাধুগুরুজনেরা বলেন, ‘যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তা আছে দেহভাণ্ডে’।
একজন যোগী, একজন সাধক দেহঅভ্যন্তরীণ এবং ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে থাকা শক্তিকে অনুসন্ধনে ব্রতী হন। সূর্যের শক্তি আমরা শরীরে গ্রহন করি। সৌরশক্তি নানাভাবে ব্যবহার করি। ব্রহ্মাণ্ডের এমন অনেক জানা ও অজানা শক্তিই আমরা গ্রহন বর্জন করে থাকি। তেমনি দেহঅভ্যন্তরীণ শক্তিও আমরা গ্রহন-বর্জন করি। মন্দ শক্তি উৎপাদক ও উৎপাদন করা থেকে দূরে থাকি, ভাল শক্তি কার্যকর করি। পূর্ণিমার পর কৃষ্ণপক্ষে চাঁদে টান লাগে, তখন গ্রীষ্মে ঝড়বৃষ্টির সম্ভবনা থাকে, শীতে শৈতপ্রবাহ বেড়ে যায়। জগতে এভাবেই শক্তি ক্রিয়াশীল আছে।
যোগমার্গের পথিক ব্রহ্মাণ্ডের শক্তির সঙ্গে দেহঅভ্যন্তরীণ শক্তির সংযোগ তৈরি করেন। দেহঅভ্যন্তরীণ শক্তিকে তেজদ্বীপ্ত রাখা এবং ব্রহ্মাণ্ড থেকে শক্তি গ্রহন করে তেজদীপ্ত থাকেন। বায়ুর সাধনে, দমের সাধনে ওই শক্তিকে আয়ত্ত্বে আনেন তিনি। সাধনার মধ্য দিয়ে দেহাভ্যন্তরীণ কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করেন। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী তেমন একজন শক্তি সাধক, যোগী। সদা জাগ্রত, চির সচেতন।
‘সমাধির উচ্চতম শিখরে গিয়ে যখন পরমতত্ত্বে পৌঁছালাম, তখন দেখি আমাতে আর অখিল ব্রহ্মান্ডের অস্তিত্বে কোন ভেদ নেই। সব মিলেমিশে একাকার।’
‘লোক’ শব্দটি প্রাচীণ ভারতে একার্ণব =(এক+অর্ণব/সমুদ্র) অর্থ্যাৎ একাকার অর্থে ব্যবহার করা হত। একাকার অর্থে এখনও লোক শব্দের ব্যবহার রয়েছে। যেমনঃ লোকালয়, লোকারণ্য। কোনস্থানে অসংখ্য মানুষ একত্রিত হলে বন/অরণ্যের সাথে তুলনা দিয়ে বলি— লোকারণ্য। একত্রে থাকার জন্যই মানুষ গোত্র/গোষ্ঠী/সমাজ সৃষ্টি করে; সেই সমাজকে আমরা লোকালয় বলেও সম্মোধন করি। তবে বর্তমানে নিছক ব্যক্তি অর্থে, খণ্ডিত অর্থে, হীন বোঝাতে এই শব্দের ব্যবহার বেশী। কেন? কোথায় ফাটল ধরলে অখন্ড-ঐক্যবদ্ধশক্তি খণ্ড হয়ে পড়ে!
এক অর্ণবের অসংখ্য ঢেউ, ঢেউয়ে অসংখ্য জলকণা নিয়ে একার্ণব। ফলে ‘লোক’ সর্বদাই জলের মত এক সমুদ্রে মিশে থাকে। বিষয়টি সকলের পক্ষেই চাক্ষুস উপলব্ধি করা সম্ভব। রাস্তায় বের হলে আপনি ‘লোক’-এর মাঝেই মিশে যাচ্ছেন; সমুদ্রের জলে মিশে যাওয়া। এভাবে লোকের সমাজেই আপনি বাস করছেন। বহুলোকের সঙ্গে আপনি বহুভাবে সম্পর্কিত হচ্ছেন। মহাকাল (cosmos) নামক এক+অর্ণবের বহু ঢেউয়ের অসংখ্য জলরাশির একটি কণা হলেন আপনি। প্রাচীন ভারতে ‘লোক’ বলতে এই কারণে ‘জল’ বোঝাত।
পৃথিবীতে জল তরল অবস্থায় থাকলেও এটি কঠিন (বরফ) এবং বায়বীয় (জলীয় বাষ্প) অবস্থাতেও পাওয়া যায়। পৃথিবীতে স্ফটিক রূপেও জলের অস্তিত্ব দেখা যায়। জল বলতে আমাদের মনে সহজ, সরল একটি বোধও আসে। মানুষটির মন জলের মতো পরিষ্কার, অংকটি জলের মত সোজা, কাজটি কারা আমার জন্য পান্তাভাত খাওয়ার মতই সোজা। জল বলতে তাই একইসঙ্গে সহজ, সরল, সহজিয়া বোঝায়।
অহং চলে গেলে নিজের মনই নিজের গুরু হয়, সৎ ও অসৎ বিচার আসে। জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তির মণিকাঞ্চন যোগ হলে শ্রদ্ধা হবে তোদের আশ্রয়, শ্রদ্ধা হবে তোদের বান্ধব এবং শ্রদ্ধাই হবে তোদের পাথেয়।
বাঁধ না দিলে, বাধা না দিলে জল নিজ থেকেই পুকুর/নদ/নদী/সমুদ্রের দিকে গড়িয়ে যায়; মানুষ যেমন লোকালয়ের দিকে, ভক্তি তেমনি ভক্তের দিকেই এগিয়ে যায়। ভক্তির মণিকাঞ্চন যার অন্তরে আছে সে স্বচ্ছ জলের মত, শ্রদ্ধেয়। কিন্তু ভক্তিহীন জ্ঞানী ‘মণিকাঞ্চন’কে জ্ঞানবিচারের পদ্ধতিতে পরখ করতে গিয়ে গোল বাঁধায়। অখণ্ডকে বোঝার স্বার্থে খণ্ড খণ্ড করে, জ্ঞানপাপের কারণেই খণ্ড অবস্থাতেই তা ফেলে রাখে। অচেতনে মন ভুলে যায় আগেকার অখণ্ডরূপ। এই কর্মফলেই মানুষের মাঝে জন্ম নেয় দূরত্ব, হানাহানি, ‘বিচ্ছেদবোধ বা বিরহবোধ’।
‘সচেতন হতে হবে। অচেতনাই জীবনের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরন্তর অভ্যাস এবং চেষ্টার ফলে তাকে সচেতনায় রূপান্তরিত করতে হবে।’
একমাত্র সচেতন-সত্ত্বার অর্থাৎ আত্মজ্ঞানের সক্রিয়তা দিয়ে অবলোকন (Look/দেখা) হয় মহাকালের (cosmic ocean) অখন্ডরূপ। এই অখন্ড অবলোকন/দরশনের একদিক অন্তর্মুখী, অপরদিক বর্হিমুখী। দুইমিলে অখণ্ড। দরশন/দর্শনবিচারে ‘যার ভেতর অবলোকন (Look) বা দর্শন আছে’ তাকেই ‘লোক’ বলা হয়। ‘যার ভেতর সব কিছু দেখতে পাওয়া যায়’ এবং ‘যে বাইরে সব কিছুকে দেখতে পায়’ তাঁদের সকলেই আদিতে ‘লোক’ পদবাচ্য ছিলেন।
প্রথম ক্ষেত্রে লোক বলতে সেই সকল ব্যক্তি বস্তু সমুদয় বোঝাত, যারা স্বচ্ছ বা ট্রান্সপারেন্ট; আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দার্শনিক বিজ্ঞানী প্রভৃতি সম্পর্কজ্ঞানী বা ব্রহ্মজ্ঞানী লোকেদের বোঝানো হত, যারা এই জগৎ সংসারের বিদ্যমান কোটি কোটি সম্পর্কসমূহ দেখতে পেতেন। বস্তুতে বস্তুতে, অনুতে পরমানুতে বিদ্যমান সকল সম্পর্ক।
‘ওরে, সে জগতের কথা মুখে বলা যায় না, বলতে গেলেই কম পড়ে যায়। বোবা যেমন মিষ্টির স্বাদ বলতে পারে না, সেই রকম আর কি!’
সম্পর্কজ্ঞানী, ব্রহ্মজ্ঞানী জগতের সকল সম্পর্কসমূহ স্বচ্ছভাবে যেমন বুঝতে ও দেখ পান, শিষ্যের মনের কথাও তিনি পড়তে সক্ষম। তেমনি স্বচ্ছ-সহজিয়া শিষ্যও গুরু-আজ্ঞা লাভের জন্য থাকেন অপেক্ষমান। এই হল গুরুশিষ্য পরম্পরা। এই কারণে ‘লোক’ বলতে জগৎ-দ্রষ্টা মানুষকে বোঝাত, স্বচ্ছ সরল মানুষকেও বোঝাত; আবার ভূলোক দ্যুলোক গোলোককেও বোঝাত।
বস্তুত, যে মানুষের অন্তর্জগৎ স্বচ্ছ, তাই বহির্জগতের সম্পর্কসমূহের তথ্য ও তত্ত্ব যার ভিতরে অবাধে প্রতিফলিত ও বিচ্ছুরিত হতে পারে, তেমনি হীরের টুকরো আদর্শ মানব-মানবী মাত্রেই ‘লোক’-পদবাচ্য। এই লোক, নর বা নারী যে কেউ হতে পারেন। এক্ষেত্রে মানুষে মানুষে কোনও ভেদাভেদ নেই। লোক শব্দের কোন লিঙ্গ সীমা নেই, যেমন নেই পরমাত্মার। সর্বপ্রকার আলো-গ্রহন-ধারণ-বিচ্ছুরণ-কারী ব্যক্তি বস্তুই লোক পদবাচ্য। পরমাণু বিজ্ঞানীদের মতে, এই লোক (পরমাত্মা) জগৎকে দেখে বলেই জগৎটা আছে।
সেই পরমাত্মার পক্ষেই সম্ভব ভক্তের স্মরণে সাড়া দেওয়া। প্রভু (নাথ) সাড়া দিচ্ছেন সন্তান/শিষ্য/ভক্তের স্মরণে। লোকের স্মরণের লোক সাড়া দিচ্ছেন। মানুষের পক্ষে মানুষ দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। শব্দতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও সহজিয়া বিচারে তাই ‘লোক’ শব্দটি অশেষ মর্যদাসম্পন্ন। সেই ‘মর্যদাসম্পন্ন লোক’-এর নাথ, বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী।
শব্দজগতে লোক-এর মর্যদা এবং বিশ্বজগতে লোক-এর মর্যদার কোন পরিমাপ হয় না। সীমা হয় না। লোক আছে বলেই বিশ্বভুবন আছে। লোকই অস্তিত্বের মূল। লোকই অস্তিত্ব। ‘লোক’ আছে বহু রকমের। ভূলোক দ্যুলোক গোলোক; স্বর্গলোক মর্ত্যলোক পাতাললোক; পশুলোক…
চার.
কিন্তু মহান ‘মর্যদাসম্পন্ন লোক’-এর সেই মর্যদা অক্ষুণ্ণ থাকে নাই। একদিন সেই মর্যদা হরণ করে, তাদের পাষণ্ড শূদ্র ম্লেচ্ছ অনার্য আদিবাসী প্রভৃতি ক্রমবিচূর্ণীভূত অজস্র অপাংক্তেয় শ্রেণীভুক্ত করে ফেলা হয়। লোকের ভক্তিকে আখ্যায়িত করা হয় ‘নিছক বিশ্বাস’ হিসেবে, তাদের জীবন ও সংস্কৃতির নাম হয়ে গেছে লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি। তাদের দাবায়ে রাখা হয় ছোটলোক বলে। বিপরীতে, শাসক মানুষকে, ক্ষমতাধর ও প্রতিপত্তিশালী মানুষকে ‘লোক’ বলতে আমরা ইতঃস্তত করি। এভাবেই চলে একের দ্বারা অন্যের মর্যদাহরণের খেলা। ছোটলোক আর বড়লোকের খেলা।
‘কাম, ক্রোধ সব রিপুই অবচেতন মনের স্তরে স্তরে সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। সুযোগ পেলেই তারা প্রকাশ হয়, কারণ মানুষ তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন নয়। অচেতন মন রিপুদের অবাধ ক্রীড়াক্ষেত্র।’
এই ‘মর্যদাসম্পন্ন’ বা ‘মর্যদাহীন’ লোক’-এর নাথ (প্রভু) হলেন শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী। তিনি পরমাত্মা। সকল লোকেরই নাথ তিনি! পরমাত্মা জগৎ ব্রহ্মাণ্ডের ভেতর-বাহিরে সর্বত্র সুক্ষ্ম, জ্যোতির্ময় রূপে বিরাজমান। তাহলে পিতার সুক্ষদেহ এখন কোন লোকে (dimension) আছে, যোগবলে সুক্ষ্মদৃষ্টি হলে হয়ত পুত্রের তা গোচর হবে। যোগবলে, কুলকুণ্ডলিনী শক্তি জাগ্রত হলে, সন্ধিনী শক্তি পর্যায়ে পৌঁছালে মিলবে সম+অধি (beyond everything)=সমাধি। তখনই কর্ণগোচর হবে ‘আমার বিনাশ নেই, আমি অবিনশ্বর। আমি আছি-আছি-আছি’ আর দৃষ্টিগোচর হবে ‘যখনই বিপদে পড়বি, আমাকে স্মরণ করবি, আমিই রক্ষা করবো।’
কলিম খানের গোলকায়িত দুনিয়ার ‘লোক’
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নুতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নুতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।
পুণঃপ্রচারে বিনীত
প্রণয় সেন
প্রণয়
গুরুকে প্রভুজ্ঞানে (নাথ=প্রভু) পিতৃজ্ঞানে ভক্তি করে শিষ্য ও সন্তানতুল্যরা। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর নামে প্রচারিত উপদেশও শিষ্য-সন্তানতুল্যরা ভক্তি নিয়ে স্মরণ করেন। এই লেখায় বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সেসব প্রচরিত উপদেশবাণীর কিছু যুক্ত করা হয়েছে এবং ‘লোক’ শব্দটির নানান অর্থ তুলে ধরা হয়েছে। বাবা লোকনাথ স্মরণে ও করণে যুক্ত থাকার নিমিত্তেই এ লেখার প্রয়াস।
দুঃখিত পীড়িত পরিত্রাণ প্রত্যাশী সমাজের মানুষ আজও বাবার কাছে যান, বাবাকে স্মরণ করেন। বাবা তাদের নাথ/প্রভু। লোকের নাথ তিনি, বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী। সর্ব্বলোক প্রসিদ্ধ। লোকরক্ষার জন্যই স্বর্গলোক হতে এমন মহতেরা ভূলোকে অবতীর্ণ হন।
এক.
বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী যাদের নাথ সেই ‘লোক’ আজও মর্যদাহীন। ছোটলোক, (জন)সাধারণ বলে তাদের পরিচয় দেওয়া হয়। ‘লোক’ শব্দটির এমন ব্যবহার হরহামেশা আমরা শুনতে পাই। যদিও আদিতে এমন ছিল না। মানব সমাজে যেমন মানবের মর্যদার ইতর-বিশেষ ঘটানো হয়েছে, শব্দসমাজেও তেমনি ইতর-বিশেষ ঘটে গিয়েছে। অন্যান্য প্রাণের ক্ষেত্রেও তাই। পিঁপড়া, মাছি, ব্যাঙ্গাচির অস্তিত্ব স্বীকার না করলে যেন কিছুই যায় আসে না। পায়ে দলাতে পারলেই মহাসুখ। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে রাসায়নিক ছিটিয়ে ফসলের জন্য উপকারী প্রাণী ধ্বংস করা হচ্ছে। লোকের শরীরের ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিষ। ‘মানুষ’ নামক কিছু ক্ষমতা প্রদর্শনকারী জীবের বাহিরে বাকী সকল প্রাণ তুচ্ছতাচ্ছিল্যের যোগ্য। লোকের এমন দশা দেখলে নিশ্চয় তাঁদের নাথেরও দুঃখ হয়। সন্তানের কষ্টে পিতা কষ্ট পান।
‘আমি নিত্য জাগ্রত। তোদের সুখে সুখী, তোদের দুঃখে দুখী। আমার বিনাশ নেই, আমি অবিনশ্বর। আমি আছি-আছি-আছি।’
দুই.
কোন কিছু অবলোকন করা না গেলে, মানুষের কাছে তা হয়ে পড়ে অলৌকিক/মিথ। ফলে অবলোকন কি করে হয়, সেও চর্চার বিষয়। কোন ঘটনা চর্মচক্ষে দেখলে আমরা সহজে বিশ্বাস করি; অন্তরচক্ষে কে কি দেখলো (লোকন করল) তা ক্যামনে বলি? তবে চর্মচক্ষে দেখতে ও সুক্ষবোধে অনুভব করতে না পারলে অনেক কথাই গল্পগুজব মাত্র, মিথ/অলৌকিক হিসেবে আখ্যায়িত হয়।
বোধের সুক্ষতার অভাবে অনেক সময় অন্যের দুঃখের কথাও আমরা অনুভব করতে পারি না, কিংবা গুরুত্বহীন মনে করি। নিজ স্থুলসত্ত্বার বাইরে অন্যসব কিছুকে পরজ্ঞানে দেখার ফলাফল এমনি হয়। কেউ আছাড় খেয়ে কোমর ভাঙ্গলে মনে মনে বলি, যাক আমি তো আছাড় খাই নাই। স্থুলবোধের, স্থুলদেহীর মন এমন স্বভাবের। সব কিছু তার কাছে বস্তুপিণ্ড মাত্র। বিরাট বস্তুবাদী! এই স্থুলবোধের কারণেই অজানা থেকে যায় অনেক রকমের সুক্ষজ্ঞান, সুক্ষবিচার।
‘আমিও তোদের মতো খাই-দাই, মল-মূত্র ত্যাগ করি। আমাকেও তোদের মতই একজন ভেবে নিস। আমাকে তোরা শরীর ভেবে ভেবেই সব মাটি করলি। আমি যে কে, তা আর কাকে বোঝাবো, সবাই তার ছোট ছোট চাওয়া নিয়েই ভুলে রয়েছে আমার প্রকৃত আমি কে।’
তিন.
যিনি শক্তি অর্থাৎ এনার্জির খবর নেন তিনি শাক্ত; সাধকের কাছেই শক্তির খবরাখবর থাকে। দেহ অর্থাৎ যন্ত্র অর্থাৎ ফর্মকে (form) আশ্রয় করে তিনি শক্তির সাধনা করেন। তেমনি বিজ্ঞানী নিকোলাই টেসলা একজন শক্তি সাধক। সে সাধনায় তিনি একদিন ‘প্রকৃত আমি’র সন্ধান পান, বোধিলাভ করেন, আত্মজ্ঞানী, ব্রহ্মজ্ঞানী হন। যোগীদের শাস্ত্র ও চর্চা আমাদের জানায়, মানুষের স্থুলদেহের মধ্যে সুক্ষ ও সুপ্তাবস্থায় শক্তিরূপিনী ‘প্রকৃত আমি’ ঘুমিয়ে থাকে; এই শক্তি লুকিয়ে আছে ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যেও। এই অর্থেই সাধুগুরুজনেরা বলেন, ‘যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তা আছে দেহভাণ্ডে’।
একজন যোগী, একজন সাধক দেহঅভ্যন্তরীণ এবং ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে থাকা শক্তিকে অনুসন্ধনে ব্রতী হন। সূর্যের শক্তি আমরা শরীরে গ্রহন করি। সৌরশক্তি নানাভাবে ব্যবহার করি। ব্রহ্মাণ্ডের এমন অনেক জানা ও অজানা শক্তিই আমরা গ্রহন বর্জন করে থাকি। তেমনি দেহঅভ্যন্তরীণ শক্তিও আমরা গ্রহন-বর্জন করি। মন্দ শক্তি উৎপাদক ও উৎপাদন করা থেকে দূরে থাকি, ভাল শক্তি কার্যকর করি। পূর্ণিমার পর কৃষ্ণপক্ষে চাঁদে টান লাগে, তখন গ্রীষ্মে ঝড়বৃষ্টির সম্ভবনা থাকে, শীতে শৈতপ্রবাহ বেড়ে যায়। জগতে এভাবেই শক্তি ক্রিয়াশীল আছে।
যোগমার্গের পথিক ব্রহ্মাণ্ডের শক্তির সঙ্গে দেহঅভ্যন্তরীণ শক্তির সংযোগ তৈরি করেন। দেহঅভ্যন্তরীণ শক্তিকে তেজদ্বীপ্ত রাখা এবং ব্রহ্মাণ্ড থেকে শক্তি গ্রহন করে তেজদীপ্ত থাকেন। বায়ুর সাধনে, দমের সাধনে ওই শক্তিকে আয়ত্ত্বে আনেন তিনি। সাধনার মধ্য দিয়ে দেহাভ্যন্তরীণ কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করেন। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী তেমন একজন শক্তি সাধক, যোগী। সদা জাগ্রত, চির সচেতন।
‘সমাধির উচ্চতম শিখরে গিয়ে যখন পরমতত্ত্বে পৌঁছালাম, তখন দেখি আমাতে আর অখিল ব্রহ্মান্ডের অস্তিত্বে কোন ভেদ নেই। সব মিলেমিশে একাকার।’
‘লোক’ শব্দটি প্রাচীণ ভারতে একার্ণব =(এক+অর্ণব/সমুদ্র) অর্থ্যাৎ একাকার অর্থে ব্যবহার করা হত। একাকার অর্থে এখনও লোক শব্দের ব্যবহার রয়েছে। যেমনঃ লোকালয়, লোকারণ্য। কোনস্থানে অসংখ্য মানুষ একত্রিত হলে বন/অরণ্যের সাথে তুলনা দিয়ে বলি— লোকারণ্য। একত্রে থাকার জন্যই মানুষ গোত্র/গোষ্ঠী/সমাজ সৃষ্টি করে; সেই সমাজকে আমরা লোকালয় বলেও সম্মোধন করি। তবে বর্তমানে নিছক ব্যক্তি অর্থে, খণ্ডিত অর্থে, হীন বোঝাতে এই শব্দের ব্যবহার বেশী। কেন? কোথায় ফাটল ধরলে অখন্ড-ঐক্যবদ্ধশক্তি খণ্ড হয়ে পড়ে!
এক অর্ণবের অসংখ্য ঢেউ, ঢেউয়ে অসংখ্য জলকণা নিয়ে একার্ণব। ফলে ‘লোক’ সর্বদাই জলের মত এক সমুদ্রে মিশে থাকে। বিষয়টি সকলের পক্ষেই চাক্ষুস উপলব্ধি করা সম্ভব। রাস্তায় বের হলে আপনি ‘লোক’-এর মাঝেই মিশে যাচ্ছেন; সমুদ্রের জলে মিশে যাওয়া। এভাবে লোকের সমাজেই আপনি বাস করছেন। বহুলোকের সঙ্গে আপনি বহুভাবে সম্পর্কিত হচ্ছেন। মহাকাল (cosmos) নামক এক+অর্ণবের বহু ঢেউয়ের অসংখ্য জলরাশির একটি কণা হলেন আপনি। প্রাচীন ভারতে ‘লোক’ বলতে এই কারণে ‘জল’ বোঝাত।
পৃথিবীতে জল তরল অবস্থায় থাকলেও এটি কঠিন (বরফ) এবং বায়বীয় (জলীয় বাষ্প) অবস্থাতেও পাওয়া যায়। পৃথিবীতে স্ফটিক রূপেও জলের অস্তিত্ব দেখা যায়। জল বলতে আমাদের মনে সহজ, সরল একটি বোধও আসে। মানুষটির মন জলের মতো পরিষ্কার, অংকটি জলের মত সোজা, কাজটি কারা আমার জন্য পান্তাভাত খাওয়ার মতই সোজা। জল বলতে তাই একইসঙ্গে সহজ, সরল, সহজিয়া বোঝায়।
অহং চলে গেলে নিজের মনই নিজের গুরু হয়, সৎ ও অসৎ বিচার আসে। জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তির মণিকাঞ্চন যোগ হলে শ্রদ্ধা হবে তোদের আশ্রয়, শ্রদ্ধা হবে তোদের বান্ধব এবং শ্রদ্ধাই হবে তোদের পাথেয়।
বাঁধ না দিলে, বাধা না দিলে জল নিজ থেকেই পুকুর/নদ/নদী/সমুদ্রের দিকে গড়িয়ে যায়; মানুষ যেমন লোকালয়ের দিকে, ভক্তি তেমনি ভক্তের দিকেই এগিয়ে যায়। ভক্তির মণিকাঞ্চন যার অন্তরে আছে সে স্বচ্ছ জলের মত, শ্রদ্ধেয়। কিন্তু ভক্তিহীন জ্ঞানী ‘মণিকাঞ্চন’কে জ্ঞানবিচারের পদ্ধতিতে পরখ করতে গিয়ে গোল বাঁধায়। অখণ্ডকে বোঝার স্বার্থে খণ্ড খণ্ড করে, জ্ঞানপাপের কারণেই খণ্ড অবস্থাতেই তা ফেলে রাখে। অচেতনে মন ভুলে যায় আগেকার অখণ্ডরূপ। এই কর্মফলেই মানুষের মাঝে জন্ম নেয় দূরত্ব, হানাহানি, ‘বিচ্ছেদবোধ বা বিরহবোধ’।
‘সচেতন হতে হবে। অচেতনাই জীবনের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরন্তর অভ্যাস এবং চেষ্টার ফলে তাকে সচেতনায় রূপান্তরিত করতে হবে।’
একমাত্র সচেতন-সত্ত্বার অর্থাৎ আত্মজ্ঞানের সক্রিয়তা দিয়ে অবলোকন (Look/দেখা) হয় মহাকালের (cosmic ocean) অখন্ডরূপ। এই অখন্ড অবলোকন/দরশনের একদিক অন্তর্মুখী, অপরদিক বর্হিমুখী। দুইমিলে অখণ্ড। দরশন/দর্শনবিচারে ‘যার ভেতর অবলোকন (Look) বা দর্শন আছে’ তাকেই ‘লোক’ বলা হয়। ‘যার ভেতর সব কিছু দেখতে পাওয়া যায়’ এবং ‘যে বাইরে সব কিছুকে দেখতে পায়’ তাঁদের সকলেই আদিতে ‘লোক’ পদবাচ্য ছিলেন।
প্রথম ক্ষেত্রে লোক বলতে সেই সকল ব্যক্তি বস্তু সমুদয় বোঝাত, যারা স্বচ্ছ বা ট্রান্সপারেন্ট; আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দার্শনিক বিজ্ঞানী প্রভৃতি সম্পর্কজ্ঞানী বা ব্রহ্মজ্ঞানী লোকেদের বোঝানো হত, যারা এই জগৎ সংসারের বিদ্যমান কোটি কোটি সম্পর্কসমূহ দেখতে পেতেন। বস্তুতে বস্তুতে, অনুতে পরমানুতে বিদ্যমান সকল সম্পর্ক।
‘ওরে, সে জগতের কথা মুখে বলা যায় না, বলতে গেলেই কম পড়ে যায়। বোবা যেমন মিষ্টির স্বাদ বলতে পারে না, সেই রকম আর কি!’
সম্পর্কজ্ঞানী, ব্রহ্মজ্ঞানী জগতের সকল সম্পর্কসমূহ স্বচ্ছভাবে যেমন বুঝতে ও দেখ পান, শিষ্যের মনের কথাও তিনি পড়তে সক্ষম। তেমনি স্বচ্ছ-সহজিয়া শিষ্যও গুরু-আজ্ঞা লাভের জন্য থাকেন অপেক্ষমান। এই হল গুরুশিষ্য পরম্পরা। এই কারণে ‘লোক’ বলতে জগৎ-দ্রষ্টা মানুষকে বোঝাত, স্বচ্ছ সরল মানুষকেও বোঝাত; আবার ভূলোক দ্যুলোক গোলোককেও বোঝাত।
বস্তুত, যে মানুষের অন্তর্জগৎ স্বচ্ছ, তাই বহির্জগতের সম্পর্কসমূহের তথ্য ও তত্ত্ব যার ভিতরে অবাধে প্রতিফলিত ও বিচ্ছুরিত হতে পারে, তেমনি হীরের টুকরো আদর্শ মানব-মানবী মাত্রেই ‘লোক’-পদবাচ্য। এই লোক, নর বা নারী যে কেউ হতে পারেন। এক্ষেত্রে মানুষে মানুষে কোনও ভেদাভেদ নেই। লোক শব্দের কোন লিঙ্গ সীমা নেই, যেমন নেই পরমাত্মার। সর্বপ্রকার আলো-গ্রহন-ধারণ-বিচ্ছুরণ-কারী ব্যক্তি বস্তুই লোক পদবাচ্য। পরমাণু বিজ্ঞানীদের মতে, এই লোক (পরমাত্মা) জগৎকে দেখে বলেই জগৎটা আছে।
সেই পরমাত্মার পক্ষেই সম্ভব ভক্তের স্মরণে সাড়া দেওয়া। প্রভু (নাথ) সাড়া দিচ্ছেন সন্তান/শিষ্য/ভক্তের স্মরণে। লোকের স্মরণের লোক সাড়া দিচ্ছেন। মানুষের পক্ষে মানুষ দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। শব্দতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও সহজিয়া বিচারে তাই ‘লোক’ শব্দটি অশেষ মর্যদাসম্পন্ন। সেই ‘মর্যদাসম্পন্ন লোক’-এর নাথ, বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী।
শব্দজগতে লোক-এর মর্যদা এবং বিশ্বজগতে লোক-এর মর্যদার কোন পরিমাপ হয় না। সীমা হয় না। লোক আছে বলেই বিশ্বভুবন আছে। লোকই অস্তিত্বের মূল। লোকই অস্তিত্ব। ‘লোক’ আছে বহু রকমের। ভূলোক দ্যুলোক গোলোক; স্বর্গলোক মর্ত্যলোক পাতাললোক; পশুলোক…
চার.
কিন্তু মহান ‘মর্যদাসম্পন্ন লোক’-এর সেই মর্যদা অক্ষুণ্ণ থাকে নাই। একদিন সেই মর্যদা হরণ করে, তাদের পাষণ্ড শূদ্র ম্লেচ্ছ অনার্য আদিবাসী প্রভৃতি ক্রমবিচূর্ণীভূত অজস্র অপাংক্তেয় শ্রেণীভুক্ত করে ফেলা হয়। লোকের ভক্তিকে আখ্যায়িত করা হয় ‘নিছক বিশ্বাস’ হিসেবে, তাদের জীবন ও সংস্কৃতির নাম হয়ে গেছে লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি। তাদের দাবায়ে রাখা হয় ছোটলোক বলে। বিপরীতে, শাসক মানুষকে, ক্ষমতাধর ও প্রতিপত্তিশালী মানুষকে ‘লোক’ বলতে আমরা ইতঃস্তত করি। এভাবেই চলে একের দ্বারা অন্যের মর্যদাহরণের খেলা। ছোটলোক আর বড়লোকের খেলা।
‘কাম, ক্রোধ সব রিপুই অবচেতন মনের স্তরে স্তরে সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। সুযোগ পেলেই তারা প্রকাশ হয়, কারণ মানুষ তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন নয়। অচেতন মন রিপুদের অবাধ ক্রীড়াক্ষেত্র।’
এই ‘মর্যদাসম্পন্ন’ বা ‘মর্যদাহীন’ লোক’-এর নাথ (প্রভু) হলেন শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী। তিনি পরমাত্মা। সকল লোকেরই নাথ তিনি! পরমাত্মা জগৎ ব্রহ্মাণ্ডের ভেতর-বাহিরে সর্বত্র সুক্ষ্ম, জ্যোতির্ময় রূপে বিরাজমান। তাহলে পিতার সুক্ষদেহ এখন কোন লোকে (dimension) আছে, যোগবলে সুক্ষ্মদৃষ্টি হলে হয়ত পুত্রের তা গোচর হবে। যোগবলে, কুলকুণ্ডলিনী শক্তি জাগ্রত হলে, সন্ধিনী শক্তি পর্যায়ে পৌঁছালে মিলবে সম+অধি (beyond everything)=সমাধি। তখনই কর্ণগোচর হবে ‘আমার বিনাশ নেই, আমি অবিনশ্বর। আমি আছি-আছি-আছি’ আর দৃষ্টিগোচর হবে ‘যখনই বিপদে পড়বি, আমাকে স্মরণ করবি, আমিই রক্ষা করবো।’
কলিম খানের গোলকায়িত দুনিয়ার ‘লোক’
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নুতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নুতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।
পুণঃপ্রচারে বিনীত
প্রণয় সেন
প্রণয়
0 comments :
Post a Comment