গ্রীক দার্শনিক জেনোফেনিস প্রায় অকাট্য যুক্তি সাজিয়ে বলে দিলেন — দ্যাখো ! গরু, ঘোড়া এবং সিংহের যদি হাত থাকত এবং সেই হাত দিয়ে যদি তারা ছবিও আঁকতে পারত মানুষের মতো, তাহলে গরুরা গরুর ছবি আঁকত ঠিক গরুর মতোই আর ঘোড়ারাও ঘোড়ার ছবি আঁকত ঘোড়ার মতোই। আর কোনো ভাবে এই গরুটি যদি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ছবি আঁকতে পারত, তাহলে সেই গরু ঈশ্বরের ছবিও আঁকত গরুর মতোই। একইভাবে ঘোড়াদের ঈশ্বরের চেহারাটাও হত ঘোড়ার প্রতিকৃতি, সিংহের ঈশ্বর সিংহ। ঠিক যেমন মানুষ ঈশ্বরের আকৃতি প্রকাশ করে মানুষেরই আদলে।
গ্রীক দার্শনিক যেভাবে ঈশ্বর-দর্শনের যুক্তি সাজিয়েছেন, সেটা প্রায় আমাদের উপনিষদের ব্রহ্মভাবনার মতো অনিবার্চনীয়, অনির্দেশ্য-স্বরূপ; কিন্তু আমাদের দার্শনিকেরা সেই ব্রহ্মভাবনাকে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন, সেখানে জেনোফেনিসকে শিশু মনে হবে। অন্যদিকে জোনোফেনিস যেটাকে মানুষের ভুল বলে ভাবছেন, আমরা ভারতীয়রা সবশেষে সেটাকেই চরম সত্য হিসেবে ধরে নিয়ে বলেছি – ঈশ্বর যখন মানুষের চেহারায় এই ধরাধামে নেমে আসেন সেটাই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ –
কৃষ্ণের যতেক খেলা সর্বোত্তম নরলীলা নরবপু তাহার স্বরূপ।
গোপবেশ বেণুকর নবকিশোর নটবর নরলীলা হয় অনুরূপ।।
অবশেষে পরম ঈশ্বরকে আমরা যেভাবে পেয়েছি, তাতে কোনো ভাবেই তাঁকে একমাত্র দার্শনিক ঋষি-মুনিদের ধ্যানগম্য কোনো অশব্দ-অস্পর্শ, অনির্বচনীয় জ্যোতিপুঞ্জ বলা যাবে না। বরঞ্চ তিনি এমন এক পরমেশ্বর যাঁকে আমরা আমাদের অতিনিকটে নিয়ে আসতে পারি কবির যুক্তিতে। সত্যিই তো একজন প্রভুসম্মিত ব্যক্তির কোনো মূল্যই নেই যদি কোনো দাসভাবাপন্ন ব্যক্তি তাঁকে প্রভু বলে না ডাকে। একজন প্রেমিকের তো কোনো মূল্যই থাকে না, যদি না কেউ লজ্জারুণ মুখে কম্প্র বক্ষে, নম্রনেত্রপাতে একবারও তাকে না বলে—ভালবাসি। কবি তাই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের চরম স্বরূপটাকে একটা মর্ত্য সম্বন্ধের আকার দিয়ে বলেছেন — আমায় নৈলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে।
পরম ঈশ্বর যেখানে মানুষের কাছে ধরা পড়ে গেছেন, সেই সুতোটার নাম ভক্তি – যে ভক্তিতে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর প্রায় চালিত হন ভক্তের হাতে। জীব গোস্বামীর মতো অত বড়ো দার্শনিক মানুষ ভক্তিকে প্রেম-ভালবাসার নামান্তর বলে চিহ্নিত করে বলেছেন – ভক্তি হল সেই ভালবাসার সুতো যার এক প্রান্ত থাকে ভগবানের হাতে আর অন্যপ্রান্ত ভক্তের হাতে –
সা চ রত্যপরাপর্যায়া। ভক্তিভর্গবতি ভক্তেষু চ
নিক্ষিপ্ত-নিজোভয়কোটিঃ সর্বদা তিষ্ঠতি।
ভক্তি যখন ভালবাসার পর্যায়ে পৌছোয়, তখনই তাঁর প্রিয়ভাব এমনই এক হৃদয়-গলিত বস্তু যা প্রকাশ হয় কতগুলি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যেমন ভালবাসার মানুষের কথা ভালবাসার লোকের কানে শুনতে ভাল লাগে, তাঁর কথা ভাবতে ভাল লাগে, আর সবচেয়ে ভাল লাগে তাঁর কথা বলতে –ঠিক যেমন রবি ঠাকুর বলেছেন –
তোমারই নাম বলবো আমি, বলবো বারে বারে।
তোমারি নাম বলব, আমি বলব, নানা ছলে।।
বস্তুত দূরগত সেই পরম ঈশ্বরকে তাঁর নাম ধরে বারবার ডাকার মধ্যে যে নিরন্তর অন্বেষণ আছে, সেটাই ভগবতভক্তির মধ্যে এক শাশ্বত রোমাঞ্চের পথ তৈরী করে দিয়েছে এবং সেই ভক্তিপথের নামই কীর্তন।
চৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িককালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, মণিপুর, ত্রিপুরা এবং বৃন্দাবনে হরিনাম-সংকীর্তনের যে ধারা তৈরী হয়েছিল, তা একদিকে যেমন জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষকে একত্র সমাবিষ্ট করেছিল, তেমনই সেটা উচ্চ- নীচ, ধনী-দরিদ্র এবং দেশ-কালের দ্বন্দ্ব অতিক্রম করে সমস্ত মানুষের মধ্যে এক সাংস্কৃতিক সমন্বয় সৃষ্টি করেছিল।
আজকের এই বিশ্বায়নের মহিমান্বিত কালে বৈচিত্র্য এবং সমন্বয় যেখানে ভারতীয় সমাজের নানান বিশিষ্টতাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করছে, সেখানে এই একবিংশ শতাব্দীতে আবার যমুনার তীরে এসে দাঁড়াতে হবে পদ-পদার্থ, সুর-স্বরের নতুন অন্বেষণা নিয়ে। চণ্ডিদাস-বিদ্যাপতির যত পদ মহাপ্রভু রাত্রি-দিনে আস্বাদন করেছেন, তারপর জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বংশীবদনের মতো পদকর্তাদের পদাবলী নিয়ে নরোত্তম দাস ঠাকুর খেতুরীর মহোৎসবে কীর্তনের পরীক্ষণ এবং নিরীক্ষণ করে সম্পূর্ণ কীর্তনভাবনার যে সংস্কার ঘটালেন, তাতে এই একবিংশে শতাব্দীতে এসে বিশ্বায়নের নতুন ভাবনায় আমরা পুনরায় তপস্যায় বসেছি এই ‘যমুনা কিনারে’।
বস্তুত এখানে আমরা ভারতবর্ষের এই প্রাচীন সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যটাকে ব্যাপ্ত দৃষ্টিতে খুঁজবো। এমনভাবেই খুঁজবো যাতে করে বৈষ্ণব পদাবলীর বড়ো-ছোটো যত পদকর্তা আছেন, তাঁদের কীর্তনাঙ্গিক পদগুলি এখানে সংকলন করতে পারি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে, যাতে পদকর্তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতে পারি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে, যাতে পদকর্তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতে পারি যথাসম্ভব ঐতিহাসিক বুদ্ধিতে। তাতে যেসব মহাজনপদ গাওয়া হয়নি কোনো কালে, সেগুলি যেমন গ্রন্থিত থাকবে, তেমনই যেগুলি গাওয়া হযেছে, সেগুলির শব্দমন্ত্র শোনানোর চেষ্টা করবো পুরাতন এবং আধুনিক কীর্তনয়াদের গলায়। এখানে স্বভাবতই প্রয়োজন হবে কীর্তনীয়াদের পরিচয়ের। আমরা সে চেষ্টাও করবো।
মনে রাখতে হবে, কীর্তনের রীতি-নীতি কালে কালে পালটেছে, গ্রামে-গঞ্জে, মন্দিরে-আখড়ায় যে কীর্তন চলত, সেগুলি প্রতিষ্ঠিত কীর্তনীয়াদের কণ্ঠে অনেক কৃত্রিম। কিন্তু ইতিহাসের বিচারে সেই সব কীর্তনীয়াদের সকলেরই ঠাঁই আছে যমুনার ধারে বসার কিন্তু ইতিহাসই বলে দেবে, সহজে আসর-মাতানো কীর্তনের মধ্যে এমন কৃত্রিমতা কোথা থেকে আসে, কেনই বা আসে। আমাদের সমস্যার জায়গা হল—সব রকম কীর্তনই – কী সহজ, কী কৃত্রিম – সবই আজ হারিয়ে যাবার জোগাড়। আমরা তাই কীর্তনের স্মরণে –মননে বসেছি আবার। আজকের এই ইঁদুর-দৌড়ের দিনে মানুষ যখন ‘আমি-আমি’ করে আপন স্বতন্ত্র্যের আন্দোলনে অবসন্ন হয়ে উঠবে, তখন সেই কালিন্দীর কূলে প্রৌঢ় কদম্বের ছায়ায় বসে আমরা সেই আত্মনিবেদনের অভিমানী সুর শোনাতে চাই এই আশায় ----
তব কি কুঞ্জপথ হমারি আশে
হেরবে আকুল শ্যাম?
বন বন ফেরই সো কি ফুকারবে
রাধা রাধা নাম?
না যমুনা, সো এক শ্যাম মম,
শ্যামক শত শত নারী –
হম যব যাওব শত শত রাধা
চরণে রহবে তারি।
তব সখি যমুনে, যাই নিকুঞ্জে,
কাহ তয়াগব দে?
হামারি লাগি এ বুন্দাবনমে,
কহ সখি, রোয়ব কে?
–ভানুসিংহের পদাবলী
আমরা ‘যমুনা কিনারে’ আজ সেই লীলায়িত কীর্তনের জন্য কাঁদতে বসেছি পদকর্তা ভানুসিংহের সঙ্গে। তিনি আত্মনামে লিখেছিলেন –
চৈতন্য যখন পথে বাহির হইলেন তখন বাংলা দেশের গানের সুর পর্যন্ত ফিরিয়া গেল। তখন সহস্র হৃদয়ের তরঙ্গ-হিল্লোলে সহস্র কণ্ঠ উচ্ছ্বসিত করিয়া নুতন সুরে আকাশে ব্যাপ্ত হইতে লাগিল। তখন রাগরাগিণী ঘর ছাড়িয়া পথে বাহির হইল, একজনকে ছাড়িয়া সহস্র জনকে বরণ করিল। বিশ্বকে পাগল করিবার জন্য কীর্তন বলিয়া এক নূতন কীর্তন উঠিল। যেমন ভাব তেমনি তাহার কণ্ঠস্বর-অশ্রুজলে ভাসাইয়া সমস্ত একাকার করিবার জন্য ক্রন্দনধ্বনি। বিজন কক্ষে বসিয়া বিনাইয়া বিনাইয়া একটিমাত্র বিরহিনীর বৈঠকি কান্না নয়, প্রেমে আকুল হইয়া নীলাকাশের তলে দাঁড়াইয়া সমস্ত বিশ্ব জগতের ক্রন্দনধ্বনি।
লেখক - নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী
ভারতের সাধক ও সাধিকা
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নূতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নূতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।
ভারতের সাধক ও সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত
প্রণয় সেন
প্রণয়
গ্রীক দার্শনিক যেভাবে ঈশ্বর-দর্শনের যুক্তি সাজিয়েছেন, সেটা প্রায় আমাদের উপনিষদের ব্রহ্মভাবনার মতো অনিবার্চনীয়, অনির্দেশ্য-স্বরূপ; কিন্তু আমাদের দার্শনিকেরা সেই ব্রহ্মভাবনাকে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন, সেখানে জেনোফেনিসকে শিশু মনে হবে। অন্যদিকে জোনোফেনিস যেটাকে মানুষের ভুল বলে ভাবছেন, আমরা ভারতীয়রা সবশেষে সেটাকেই চরম সত্য হিসেবে ধরে নিয়ে বলেছি – ঈশ্বর যখন মানুষের চেহারায় এই ধরাধামে নেমে আসেন সেটাই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ –
কৃষ্ণের যতেক খেলা সর্বোত্তম নরলীলা নরবপু তাহার স্বরূপ।
গোপবেশ বেণুকর নবকিশোর নটবর নরলীলা হয় অনুরূপ।।
অবশেষে পরম ঈশ্বরকে আমরা যেভাবে পেয়েছি, তাতে কোনো ভাবেই তাঁকে একমাত্র দার্শনিক ঋষি-মুনিদের ধ্যানগম্য কোনো অশব্দ-অস্পর্শ, অনির্বচনীয় জ্যোতিপুঞ্জ বলা যাবে না। বরঞ্চ তিনি এমন এক পরমেশ্বর যাঁকে আমরা আমাদের অতিনিকটে নিয়ে আসতে পারি কবির যুক্তিতে। সত্যিই তো একজন প্রভুসম্মিত ব্যক্তির কোনো মূল্যই নেই যদি কোনো দাসভাবাপন্ন ব্যক্তি তাঁকে প্রভু বলে না ডাকে। একজন প্রেমিকের তো কোনো মূল্যই থাকে না, যদি না কেউ লজ্জারুণ মুখে কম্প্র বক্ষে, নম্রনেত্রপাতে একবারও তাকে না বলে—ভালবাসি। কবি তাই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের চরম স্বরূপটাকে একটা মর্ত্য সম্বন্ধের আকার দিয়ে বলেছেন — আমায় নৈলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে।
পরম ঈশ্বর যেখানে মানুষের কাছে ধরা পড়ে গেছেন, সেই সুতোটার নাম ভক্তি – যে ভক্তিতে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর প্রায় চালিত হন ভক্তের হাতে। জীব গোস্বামীর মতো অত বড়ো দার্শনিক মানুষ ভক্তিকে প্রেম-ভালবাসার নামান্তর বলে চিহ্নিত করে বলেছেন – ভক্তি হল সেই ভালবাসার সুতো যার এক প্রান্ত থাকে ভগবানের হাতে আর অন্যপ্রান্ত ভক্তের হাতে –
সা চ রত্যপরাপর্যায়া। ভক্তিভর্গবতি ভক্তেষু চ
নিক্ষিপ্ত-নিজোভয়কোটিঃ সর্বদা তিষ্ঠতি।
ভক্তি যখন ভালবাসার পর্যায়ে পৌছোয়, তখনই তাঁর প্রিয়ভাব এমনই এক হৃদয়-গলিত বস্তু যা প্রকাশ হয় কতগুলি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যেমন ভালবাসার মানুষের কথা ভালবাসার লোকের কানে শুনতে ভাল লাগে, তাঁর কথা ভাবতে ভাল লাগে, আর সবচেয়ে ভাল লাগে তাঁর কথা বলতে –ঠিক যেমন রবি ঠাকুর বলেছেন –
তোমারই নাম বলবো আমি, বলবো বারে বারে।
তোমারি নাম বলব, আমি বলব, নানা ছলে।।
বস্তুত দূরগত সেই পরম ঈশ্বরকে তাঁর নাম ধরে বারবার ডাকার মধ্যে যে নিরন্তর অন্বেষণ আছে, সেটাই ভগবতভক্তির মধ্যে এক শাশ্বত রোমাঞ্চের পথ তৈরী করে দিয়েছে এবং সেই ভক্তিপথের নামই কীর্তন।
চৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িককালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, মণিপুর, ত্রিপুরা এবং বৃন্দাবনে হরিনাম-সংকীর্তনের যে ধারা তৈরী হয়েছিল, তা একদিকে যেমন জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষকে একত্র সমাবিষ্ট করেছিল, তেমনই সেটা উচ্চ- নীচ, ধনী-দরিদ্র এবং দেশ-কালের দ্বন্দ্ব অতিক্রম করে সমস্ত মানুষের মধ্যে এক সাংস্কৃতিক সমন্বয় সৃষ্টি করেছিল।
আজকের এই বিশ্বায়নের মহিমান্বিত কালে বৈচিত্র্য এবং সমন্বয় যেখানে ভারতীয় সমাজের নানান বিশিষ্টতাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করছে, সেখানে এই একবিংশ শতাব্দীতে আবার যমুনার তীরে এসে দাঁড়াতে হবে পদ-পদার্থ, সুর-স্বরের নতুন অন্বেষণা নিয়ে। চণ্ডিদাস-বিদ্যাপতির যত পদ মহাপ্রভু রাত্রি-দিনে আস্বাদন করেছেন, তারপর জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বংশীবদনের মতো পদকর্তাদের পদাবলী নিয়ে নরোত্তম দাস ঠাকুর খেতুরীর মহোৎসবে কীর্তনের পরীক্ষণ এবং নিরীক্ষণ করে সম্পূর্ণ কীর্তনভাবনার যে সংস্কার ঘটালেন, তাতে এই একবিংশে শতাব্দীতে এসে বিশ্বায়নের নতুন ভাবনায় আমরা পুনরায় তপস্যায় বসেছি এই ‘যমুনা কিনারে’।
বস্তুত এখানে আমরা ভারতবর্ষের এই প্রাচীন সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যটাকে ব্যাপ্ত দৃষ্টিতে খুঁজবো। এমনভাবেই খুঁজবো যাতে করে বৈষ্ণব পদাবলীর বড়ো-ছোটো যত পদকর্তা আছেন, তাঁদের কীর্তনাঙ্গিক পদগুলি এখানে সংকলন করতে পারি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে, যাতে পদকর্তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতে পারি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে, যাতে পদকর্তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতে পারি যথাসম্ভব ঐতিহাসিক বুদ্ধিতে। তাতে যেসব মহাজনপদ গাওয়া হয়নি কোনো কালে, সেগুলি যেমন গ্রন্থিত থাকবে, তেমনই যেগুলি গাওয়া হযেছে, সেগুলির শব্দমন্ত্র শোনানোর চেষ্টা করবো পুরাতন এবং আধুনিক কীর্তনয়াদের গলায়। এখানে স্বভাবতই প্রয়োজন হবে কীর্তনীয়াদের পরিচয়ের। আমরা সে চেষ্টাও করবো।
মনে রাখতে হবে, কীর্তনের রীতি-নীতি কালে কালে পালটেছে, গ্রামে-গঞ্জে, মন্দিরে-আখড়ায় যে কীর্তন চলত, সেগুলি প্রতিষ্ঠিত কীর্তনীয়াদের কণ্ঠে অনেক কৃত্রিম। কিন্তু ইতিহাসের বিচারে সেই সব কীর্তনীয়াদের সকলেরই ঠাঁই আছে যমুনার ধারে বসার কিন্তু ইতিহাসই বলে দেবে, সহজে আসর-মাতানো কীর্তনের মধ্যে এমন কৃত্রিমতা কোথা থেকে আসে, কেনই বা আসে। আমাদের সমস্যার জায়গা হল—সব রকম কীর্তনই – কী সহজ, কী কৃত্রিম – সবই আজ হারিয়ে যাবার জোগাড়। আমরা তাই কীর্তনের স্মরণে –মননে বসেছি আবার। আজকের এই ইঁদুর-দৌড়ের দিনে মানুষ যখন ‘আমি-আমি’ করে আপন স্বতন্ত্র্যের আন্দোলনে অবসন্ন হয়ে উঠবে, তখন সেই কালিন্দীর কূলে প্রৌঢ় কদম্বের ছায়ায় বসে আমরা সেই আত্মনিবেদনের অভিমানী সুর শোনাতে চাই এই আশায় ----
তব কি কুঞ্জপথ হমারি আশে
হেরবে আকুল শ্যাম?
বন বন ফেরই সো কি ফুকারবে
রাধা রাধা নাম?
না যমুনা, সো এক শ্যাম মম,
শ্যামক শত শত নারী –
হম যব যাওব শত শত রাধা
চরণে রহবে তারি।
তব সখি যমুনে, যাই নিকুঞ্জে,
কাহ তয়াগব দে?
হামারি লাগি এ বুন্দাবনমে,
কহ সখি, রোয়ব কে?
–ভানুসিংহের পদাবলী
আমরা ‘যমুনা কিনারে’ আজ সেই লীলায়িত কীর্তনের জন্য কাঁদতে বসেছি পদকর্তা ভানুসিংহের সঙ্গে। তিনি আত্মনামে লিখেছিলেন –
চৈতন্য যখন পথে বাহির হইলেন তখন বাংলা দেশের গানের সুর পর্যন্ত ফিরিয়া গেল। তখন সহস্র হৃদয়ের তরঙ্গ-হিল্লোলে সহস্র কণ্ঠ উচ্ছ্বসিত করিয়া নুতন সুরে আকাশে ব্যাপ্ত হইতে লাগিল। তখন রাগরাগিণী ঘর ছাড়িয়া পথে বাহির হইল, একজনকে ছাড়িয়া সহস্র জনকে বরণ করিল। বিশ্বকে পাগল করিবার জন্য কীর্তন বলিয়া এক নূতন কীর্তন উঠিল। যেমন ভাব তেমনি তাহার কণ্ঠস্বর-অশ্রুজলে ভাসাইয়া সমস্ত একাকার করিবার জন্য ক্রন্দনধ্বনি। বিজন কক্ষে বসিয়া বিনাইয়া বিনাইয়া একটিমাত্র বিরহিনীর বৈঠকি কান্না নয়, প্রেমে আকুল হইয়া নীলাকাশের তলে দাঁড়াইয়া সমস্ত বিশ্ব জগতের ক্রন্দনধ্বনি।
লেখক - নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী
ভারতের সাধক ও সাধিকা
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে চাইলে অবশ্যই দেখুন আমাদের সকলের এই নূতন চ্যানেলটি, আর সর্বদা আনন্দে থাকুন ও আনন্দে রাখুন সকলকে : https://bit.ly/2OdoJRN
ভারতের সাধক ও সাধিকা গ্রুপের সকল সদস্যদের কাছে আমার বিনীত আবেদন,
ভারতের সকল সাধক ও সাধিকার ভাবধারা সম্প্রচার ও পুনঃপ্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের এই নূতন ইউটিউব চ্যানেল,
আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
এটি একটি মহৎ প্রয়াস, আপনিও এর অংশীদার হোন।
ভারতের সাধক ও সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত
প্রণয় সেন
প্রণয়
0 comments :
Post a Comment